নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে প্রশ্ন ও বিতর্ক
দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্ব বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে পাঠ্যক্রমের পরিবর্তন নতুন কোনো বিষয় নয়; বরং এটা একটা নিয়মিত বিষয়। বাস্তবতার সঙ্গে সংগতি রেখে আগাম ভাবনায় সেটা করা সংগত। এটা শুধু নীতিতে নয়, এর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ ও কাঠামো তৈরি করাও জরুরি। কিন্তু সেটা না করে নতুন শিক্ষাক্রম ঘোষণা করাতেই বিপত্তি হয়েছে। শিক্ষানীতির আলোকে ২০২১ সালে যে পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করা হয়েছে, সেই আলোচনাটা অনেক বড়। প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিকের প্রতিটি পাঠ্যক্রম নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করার সুযোগ আছে। কিন্তু এখানে মোটাদাগে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করছি:
১. প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। শিশুদের আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষাদান করা হবে। প্রাথমিকে কোনো পুস্তক থাকবে না। শিক্ষকেরা নিজেরাই তাদের লেখাপড়া তথা কারিকুলাম তৈরি করবেন। এর সবকিছু খারাপ মনে করি না। কিন্তু এখানে একটা বড় আলোচনা ও বিতর্ক হচ্ছে, এই ব্যবস্থা ও পদ্ধতির বাস্তবায়ন এবং কার্যকর করার বাস্তব অবস্থা দেশে বিদ্যমান আছে কি না? জাপানে প্রাথমিক পর্যায়ে এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। কিন্তু শিক্ষকের মান ও শিক্ষার পরিবেশের অনেক কিছুই আমাদের দেশে নেই। তাই এই ব্যবস্থা কার্যকর করতে এখানে একটা বড় সংকট হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
২. শিক্ষাকে মুখস্থনির্ভরতা থেকে বের করে অনুশীলন ও প্রয়োগনির্ভর শিক্ষার কথা বলা হয়েছে, এই ধারণা অংশত ঠিক আছে। কিন্তু সব ক্ষেত্রে এমন ভাবনা অত্যন্ত বিপজ্জনক। গণিত, বিজ্ঞান, ভাষা, প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। যেমন গণিত, বিজ্ঞানের নানা শাখায় গবেষণা ও পরীক্ষার জন্য নামতা, সূত্র, তত্ত্ব মনে রাখা বাঞ্ছনীয়। জাপানের শিক্ষার্থীদের চার থেকে পাঁচ হাজার কানজি (অক্ষর) মাথায় নিয়ে ঘুরতে হয়। এ জন্য জাপানের শিক্ষার্থীদের স্মরণশক্তির প্রতিভা বিশ্বে অনন্য মর্যাদা পেয়েছে।
৩. শিক্ষার মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। উন্নত দেশগুলোয় এই ধারা অনেক আগে থেকেই প্রচলিত। তবে আমাদের দেশের যে শিক্ষাকাঠামো এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ, তাতে এই ব্যবস্থা কার্যকর করার আগে অনেক প্রস্তুতি ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন আছে। এ বিষয়ে কয়েকজন শিক্ষকের মতামত জেনেছি। তাঁদের মন্তব্য, এ জন্য শিক্ষকদের যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, তা ছিল খুবই নিম্নমানের। মাস্টার ট্রেইনারদের অবস্থাও ছিল করুণ।
পরীক্ষা, টেস্ট নাকচ করার ধারণা ঠিক নয়। প্রচলিত পদ্ধতির না হলেও নানা পর্যায়ে ও স্তরে মাস-বছরের লিখিত পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকা দরকার। সেটা না হলে শিক্ষার্থীরা গণিত, বিজ্ঞান, সমাজ, সাহিত্যের বই পড়বে না। পাঠ এড়ানোর প্রবণতা শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। তারা কম পড়ে, কম পরিশ্রম করে অধিক ফল পেতে চায়। এ জন্য শিক্ষার ধারাবাহিক মান নির্ধারণে এ পদ্ধতি প্রয়োজন। বিশ্বের সর্বত্রই এ ব্যবস্থা কার্যকর আছে।