চলতি সশস্ত্র সংগ্রাম মিয়ানমারের চেহারা পাল্টে দিতে পারে
আলতাফ পারভেজ লেখক ও গবেষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতকোত্তর। ডাকসুর নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনী: ইতিহাসের পুনর্পাঠ, বার্মা: জাতিগত সংঘাতের সাত দশক, শ্রীলঙ্কার তামিল ইলম, গ্রামসি ও তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা, মাওলানা মওদূদীর রাষ্ট্রচিন্তা: একটি পর্যালোচনা, যোগেন মণ্ডলের বহুজনবাদ ও দেশভাগ প্রভৃতি তাঁর গুরুত্বপূর্ণ বই। সম্প্রতি মিয়ানমারের জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলোর মিলিত সংগ্রামে সামরিক শাসন উচ্ছেদের সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার সঙ্গে।
এ সময়ে ‘অপারেশন-১০২৭’ মিয়ানমারের পরিস্থিতি পরিবর্তনে কতটুকু সফল হবে?
আলতাফ পারভেজ: ‘অপারেশন ১০২৭’ যারা শুরু করেছিল, তারা গত ২৭ নভেম্বর থেকে অপারেশন কোড বদল করে এটার নাম রেখেছে ‘অপারেশন-১১২৭’; অর্থাৎ এখন একই অপারেশন নতুন নামে চলবে। নাম পরিবর্তনের একটা ব্যাখ্যা হিসেবে মিয়ানমারের ‘ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ বলেছে, আগের অভিযানটা ছিল বিশেষ বিশেষ এলাকাকেন্দ্রিক। এখন তারা জাতীয়ভাবে প্রতিরোধ যুদ্ধটা ছড়িয়ে দিতে চায়। এই অপারেশন দেশটির পরিস্থিতিতে একটা গুণগত ও পরিমাণগত পরিবর্তন এনেছে। প্রথমত, যাঁরা এত দিন সামরিক জান্তাবিরোধী গেরিলা দলগুলোর শক্তি-সামর্থ্য নিয়ে সন্দিহান ছিলেন, তাঁদের অনেকখানি ভুল ভেঙেছে। এই অভিযানের প্রথম ৩০ দিনে জান্তা বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় প্রায় ১৮০টি চৌকি হারিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, গেরিলা দলগুলোর মধ্যে বিস্ময়করভাবে সমন্বয় দেখা যাচ্ছে। আমরা জানি, মিয়ানমারে সাতটি প্রদেশ এবং সাতটি বিভাগ রয়েছে। এর প্রতিটি প্রদেশের গেরিলা দল কিন্তু পৃথক পৃথক। কিন্তু তাদের অনেকের মাঝে এবার চমৎকার সমন্বয় দেখা যাচ্ছে। তৃতীয়ত, আঞ্চলিক এসব গেরিলা দলের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় মিয়ানমারের বাহিনীতে বামার তরুণেরা এবার গেরিলাযুদ্ধে শরিক হয়েছেন। এটা এবারের যুদ্ধের একটা নতুন দিক। অতীতে বিভিন্ন জাতির আঞ্চলিক গেরিলারা বামার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ত। এখন সেনাবাহিনীকে তাদের জাতির তরুণ গেরিলাদেরও মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
এবারের পরিস্থিতির আরেকটি নতুন দিক হলো, চীন হঠাৎ করে গেরিলা দলগুলোকে মদদ দিচ্ছে। যদিও এই মদদ তাদের নিজস্ব স্বার্থে এবং সাময়িক চরিত্রের। কিন্তু এটাও মিয়ানমারের পরিস্থিতিতে একটা নতুন উপাদান। কারণ এত দিন চীন সামরিক জান্তাকে একচেটিয়াভাবে সহায়তা করে এসেছে।
পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ) এবং জাতিগত অপরাপর সশস্ত্র সংগঠনের সঙ্গে মিয়ানমারের সাধারণ জনগণের সম্পৃক্ততা কেমন?
আলতাফ পারভেজ: ‘মিয়ানমারের সাধারণ জনগণ’ কথাটা ভালোভাবে বোঝা দরকার। এ দেশের মূল জনগোষ্ঠী হলো বামার। আর আছে অনেকগুলো আঞ্চলিক জাতি। যেমন—কারেন, কাচিন, শান, রাখাইন ইত্যাদি। আঞ্চলিক প্রায় প্রতিটি দল বহু বছর ধরে স্বায়ত্তশাসনের জন্য সশস্ত্র যুদ্ধ করছে। যাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করছে সেই কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনীটি হলো বামারদের। ফলে এত দিন গৃহযুদ্ধ হচ্ছিল আসলে ‘বামার বনাম অন্যান্য জাতি’র মধ্যে। এবার সেনাবাহিনী যখন অং সান সু চির দলকে ক্ষমতায় বসতে দিল না, তখন বামারদের নিজেদের মাঝেই সংঘাত বেধে যায়। গণতন্ত্রপন্থী সু চি-সমর্থক তরুণেরা তখন পিপলস ডিফেন্স ফোর্স গঠন করে গেরিলাযুদ্ধে নামেন। ফলে আঞ্চলিক গেরিলা দলগুলোর সঙ্গে পিডিএফও গৃহযুদ্ধে শরিক হয়েছে।
আঞ্চলিক গেরিলা দলগুলোর প্রতি নিজ নিজ জাতির পূর্ণ সমর্থনই আছে। অন্যদিকে, পিডিএফগুলোর প্রতি সব বামারের সমর্থন আছে— এমন বলা যায় না। তবে বামার অঞ্চলগুলোতে তাদের পরিসর বাড়ছে। বামারদের মধ্যে ভিক্ষুসংঘ ও সেনাবাহিনীর প্রভাব এখনো কম নয়। এই দুই শক্তি আবার আদর্শিকভাবে বেশ কাছাকাছি। তারা উগ্র বামার জাতীয়তাবাদী আদর্শের। তাই বামার পিডিএফগুলোকে এদের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বামার জাতীয়তাবাদের মূল শক্তির ভিত্তি। আবার চীন ও রাশিয়াও তাদের বেশ শক্তি জুগিয়েছে অতীতে। সশস্ত্র বাহিনী হিসেবে এরা বেশ শক্তিশালী ও চৌকস। ফলে জনসমাজ থেকে তাদের উপড়ে ফেলা সহজ নয়। কিন্তু গেরিলাদের অগ্রগতি ঘটছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- সশস্ত্র সংগঠন
- সামরিক শাসন