আইন আছে, প্রয়োগ নেই এ অবস্থা আর কতকাল?
ঢাকা-সিলেট, সিলেট-ঢাকা এই পথে মাসে না হলেও দেড়-দুই মাসে অন্তত একবার আমাকে যাওয়া-আসা করতে হয়। ফলে এই হাইওয়ের হাল-হকিকত আমার মোটামুটি জানা। রাস্তার গুণগত মান দেশের অন্যান্য জনপথের তুলনায় একেবারে খারাপ না, বরং ভালোই বলা চলে। সমস্যা অন্য জায়গায়। প্রায় আড়াই শ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে প্রায়ই ৮-৯ ঘণ্টা সময় লেগে যায়। এর প্রধান কারণ নামে হাইওয়ে হলেও এই জনপথে ছোট, বড়, মাঝারি সব ধরনের যানবাহন চলাচল করে। এমনকি রিকশাও—যার প্রায় সবই ব্যাটারিচালিত। এরা চলে মোটরযানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। এর চালকের বসার ভঙ্গিটা দেখার মতো। বাঁ পা-টা যথারীতি পেডাল বরাবর ঝোলানো থাকলেও ডান পা-টি থাকে পুরোপুরি মোড়ানো। ওই অবস্থায় চালককে দেখলে মনে হয় তিনি তাঁর বৈঠকখানায় আয়েশ করে বসে ইয়ার-বকশিদের সঙ্গে আলবোলায় তামাক টানতে টানতে আড্ডা দিচ্ছেন। যে গতিতে তাঁর যানটি হাইওয়ের ওপর দিয়ে চলে তা আর যা-ই হোক আমাদের পরিচিত দু’পায়ে কষে পেডাল মারা রিকশাচালক কল্পনাও করতে পারবেন না।
ব্যাটারিচালিত রিকশা তো নয়, যেন আরবি তাজি ঘোড়া ছুটে চলেছে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে ঢাকা-সিলেট পথে ভুলতা পার হয়ে নরসিংদীর বিখ্যাত মাধবদী বাজার হয়ে পাঁচদোনা-নরসিংদী-ভেলানগর-ইটাখলা পথে গেলেই দেখবেন ওই সব যানবাহনের চালক সাহেব কেমন মোগল বাদশাহ সেজে সিংহাসনে হাঁটু মুড়ে বসে আছেন, আর তাঁর পেয়ারা বাহনটি সিটে বসা যাত্রীদের পিলে কাঁপিয়ে হাইওয়ে দিয়ে ছুটে চলেছে। যেন পাল্লা দিচ্ছে হাইওয়ের খানদানি মালিক ট্রাক সাহেব-বাস সাহেবের সঙ্গে। অথচ রিকশা (ব্যাটারি অথবা নো-ব্যাটারি), বাইসাইকেল, ঠেলাগাড়ি, গরুর গাড়ি ইত্যাদির চলাচল আইনত নিষিদ্ধ হাইওয়েতে। সেই আইন মানা হচ্ছে কি না দেখার জন্য আছে হাইওয়ে পুলিশ নামক বিশেষ বাহিনী। এই বাহিনীর জন্ম খুব বেশি দিন আগে হয়নি। এদের দায়িত্ব পালন করার কথা জনপথে। কিন্তু রাস্তায় এদের দেখা পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। ফলে যেখানে হয়তো সর্বোচ্চ ৮০ কিলোমিটার গতিতে যাওয়ার কথা, সেখানে বাসচালক-ট্রাকচালকরা তো বটেই, এমনকি ‘কার’চালকরাও চলেন ফরমুলা ওয়ান-এর ড্রাইভারের মতো।
এখানে একটা কথা উল্লেখ না করলেই নয়। হাইওয়েতে যেসব বাস চলে এর সবই কোনো না কোনো কম্পানির মালিকানাধীন। দু-একটি বাস কম্পানি আবার এতই শক্তিশালী যে তাদের চালকরা রাস্তা দিয়ে চলেন তাঁদের নিজস্ব নিয়মমতো, দেশের আইন-কানুনের বড় একটা ধার তাঁরা ধারেন না। অন্য কোনো যানবাহন তাঁদের সাইড না দিলে তাঁরা রীতিমতো গোস্বা হন এবং ভাব দেখান এমন যে ‘দাঁড়া, এখন তোরে ছাইড়া দিলাম, এরপর পাইয়া লই, অ্যায়সা বাটাম দিমু...’ ইত্যাদি। রাস্তায় এসব কম্পানির বাসের ছায়া দেখলেই অন্যরা রীতিমতো সালাম জানিয়ে ‘পাস’ দিয়ে দেয়। যেন হেডমাস্টার স্যারের সামনে পড়ে গেছে ক্লাস সেভেনের ছাত্রটি। অথচ আইন-কানুন সবার জন্য সমান। এগুলো দেখার দায়িত্ব আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর। হাইওয়ে পুলিশ বাহিনীটি সৃষ্টিই করা হয়েছে এই জন্য, ঘরে বসে রিমোট কন্ট্রোলে রাস্তার ট্রাফিক দেখার জন্য নয়। জনপথে যদি পুলিশ, বিশেষ করে হাইওয়ে পুলিশের তৎপরতা আরো দৃষ্টিগোচর হতো, যদি নির্দিষ্ট গতিসীমার বেশি স্পিডে যাঁরা গাড়ি চালান, যাঁদের গাড়ির এবং চালকের কাগজপত্র নেই অথবা থাকলেও ত্রুটিপূর্ণ, তাঁদের বিরুদ্ধে যদি অকুস্থলে (অন দ্য স্পট) আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হতো, তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা অবশ্যই অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা যেত।
এই যে হঠাৎ করে চলন্ত বাসে নারী নির্যাতনের ঘটনা এত বেড়ে গেছে তা-ও কিন্তু বন্ধ করা যেত যদি রাতের বেলা বিভিন্ন স্টপেজে পুলিশ আচমকা তল্লাশি চালাত। এই প্রস্তাবটি শুনেই আমি জানি কোনো কোনো স্মার্ট পাঠক ভুরু কুঁচকাচ্ছেন, তাঁরা বলবেন, ‘হুঁ, এমনিতেই নানা অজুহাতে পুলিশ ড্রাইভারদের ছুলাতে বাকি রাখে না, তার ওপর রাতে-বিরেতে যদি বাসে চেকিংয়ের সিস্টেম চালু করেন, তাহলে তো পুলিশের পোয়াবারো। ’ হ্যাঁ, পুলিশের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ তো সেই আদ্যিকাল থেকেই আমরা শুনে আসছি। এটা যে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন তাও নয়। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি এভাবেই চলতে থাকবে রোজ কিয়ামত পর্যন্ত? আমরা একদিকে আমাদের মাথাপিছু আয় নিয়ে, শিক্ষিতের হার নিয়ে, পদ্মা সেতু নিয়ে (সংগত কারণেই) বড়াই করব, অন্যদিকে আমাদের মেয়েরা বাসে-ট্রেনে চড়ে নির্ভয়ে সম্ভ্রমে চলাফেরা করতে পারবে না, এটা কেমন কথা? আর তাও যদি হতো এটা চলে আসছে সেই ব্রিটিশ আমল-পাকিস্তানি আমল থেকে, তাহলেও একটা কথা ছিল। কিন্তু না, ওই সব আমলে যানবাহনে নারীদের শ্লীলতাহানি বা গুণ্ডা-বদমাশদের যথেচ্ছ আচরণ ছিল না বললেই চলে। আর এখন? এখন এসব অপরাধ সংঘটিত হয়নি এমন দিনের দেখা পাওয়া যায় না। আর দিন দিন এসব অপরাধ যেন বেড়েই চলেছে।