এ জগতে কী আছে বিকল্পহীন
এই বঙ্গমুলুকে একেক সময় একেক ধারা তৈরি হয়, একটা প্রবণতা গণ হয়ে হাজির হয়। এটা এ মাটির রোগ শুধু, নাকি সব দেশে সব কালেই ছিল বা আছে, কে জানে। কেউ কিছু একটা করে বা লিখে বা বলে আলোচনায় এলে দেখা যায় অন্য অনেকেই সে পথে হাঁটছে। শব্দ ব্যবহারের সময়ও অনেককে দেখা যায় এই প্রবণতার ফেরে পড়তে। জনপরিসরে চালু শব্দ-রাজনীতির ফাঁদে পড়ে যেতে দেখা যায় অনেক বিদগ্ধ লেখককেও। অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে এমন অতিশয়োক্তি করতে দেখা যায় অনেককে, যা সাধারণ্যে মানালেও বুদ্ধিজীবিতার সঙ্গে যায় না।
এ প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে। আগে প্রবণতার কিছু নমুনা দেখা যাক। মোবাইল ডিভাইসে যেদিন থেকে ফ্রন্ট ক্যামেরা যুক্ত হলো, সেদিন থেকেই সেলফি এক ভীষণ ট্রেন্ডি বিষয় হয়ে দাঁড়াল। হবে না কেন? কে না জানে, আত্মপ্রেমই বড় প্রেম। না, সেলফি এর আগেও মানুষ তুলেছে, কিন্তু ছবি তোলার ডিভাইসের ক্যামেরা ‘ফ্রন্টাল’ ছিল না বলে, এত বাড়বাড়ন্তি ছিল না। মুশকিল হলো, মোবাইল ডিভাইসে ফ্রন্ট ক্যামেরা আসার পর।
কতটা মুশকিল? মানুষ ভাইরাল সেলফি তুলতে অসম্ভব সাধনে নেমে পড়ছে। এই তো গত মে মাসে চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় রেললাইনে সেলফি তুলতে গিয়ে এক কিশোর গুরুতর আহত হলো। শেষ পর্যন্ত মারাও গেল সে চিকিৎসাধীন অবস্থায়। এটিই প্রথম নয়। এর আগেও রেললাইনে সেলফি তুলতে গিয়ে এই বঙ্গেই বহুজন মরেছে। বয়সের বিচারও নেই। মৃতের তালিকায় আছে শিশু-কিশোর থেকে মাঝবয়সীও। ফলে একে ঠিক কৈশোরিক উচ্ছ্বাস বা অ্যাডভেঞ্চারপ্রবণতা দিয়ে ব্র্যাকেটবন্দী করা চলে না।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে এমন হাজারটা প্রবণতার উদাহরণ দেওয়া যাবে। সেদিকে আর না যাওয়াই ভালো। লেখালেখি বা কথা বলার ক্ষেত্রেও দেখা মেলে এমন কিছু শব্দ ও প্রবণতার। গত কয়েক বছরে এমনই এক শব্দ ও তা ব্যবহারের প্রবণতা দেখা দিয়েছে—বিকল্পহীন। কথায় কথায় এটা, ওটা, সেটাকে ‘অবিকল্প’ ঘোষণার এক মারি দেখা দিয়েছে যেন। এতেও কৈশোরিক কোনো ব্যাপার নেই। বয়সনির্বিশেষে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষই নানা উদ্দেশ্যে শব্দটি প্রয়োগ করছে। এই দেখে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে জগতে বিকল্পহীন বস্তু আসলে কী? আদৌ এমন কিছুর অস্তিত্ব আছে কী?
একটু খুলে বলা যাক। এই যে হঠাৎ লোডশেডিং চলছে গোটা দেশে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন অক্ষমতাই হোক বা সঞ্চালনজনিত সংকটই হোক, কিংবা আন্তর্জাতিক জ্বালানি তেলের বাজারের ফেরেই হোক, বিদ্যুৎহীনতার কিন্তু নাভিশ্বাস ঠিকই উঠছে। এতে মেজাজ চড়ছে, ক্ষোভ হচ্ছে, নানা গুলতানি হচ্ছে শহর বা গ্রামেও। তাই বলে আলোহীন অন্ধকারে নিশ্চয় বসে থাকছেন না আপনি। একটা চার্জার লাইট, ব্যাটারি লাইট, জেনারেটর, আইপিএস, মোমবাতি, হারিকেন বা কুপিবাতি হলেও খুঁজে নিয়ে অন্ধকারের ভূতটাকে ঠিকই তাড়াচ্ছে মানুষ; যার যেমন সামর্থ্য আরকি। প্রতিপক্ষ যখন অন্ধকার, তখন কিন্তু সে আলোর বিবিধ উৎস ঠিকই খুঁজে নিচ্ছে। হতোদ্যম হয়ে কেউ বসে নেই।
আসা যাক যোগাযোগের ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন বিশ্ব শাসন করা চিঠি এখন স্মৃতিগদ্য হয়ে গেছে। এ নিয়ে রোমান্টিক অতীতচারণ চলে, কিন্তু একে নিয়ে বসে থাকলে চলে না। তার বিকল্প হিসেবে এখন আছে হাজারটা মাধ্যম—মোবাইল, ল্যান্ডফোন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, আরও কত-কী! চিঠিপ্রেমী লোক এখন তার চিঠিপ্রেম নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দেয়, চিঠি লেখে না। লাঙল গেছে, ট্রাক্টর এসেছে; জমি কিন্তু অনাবাদি নেই। সিনেমা হল বা টেলিভিশনের জায়গা ক্রমেই নিয়ে নিচ্ছে ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো। প্রমত্তা পদ্মা পাড়ে বইঠার নৌকার বিকল্প হিসেবে এসেছে ইঞ্জিনের নৌকা, তাকে হটিয়ে লঞ্চ, ফেরি ইত্যাদি; আর সবশেষে পদ্মা সেতু তো চোখের সামনেই হলো। এখন তো জলে না ভেসেই পদ্মা পার হচ্ছে মানুষ। মানুষ দেখিয়ে দিয়েছে বিকল্প কাকে বলে।
শ্রীলঙ্কার দিকেই তাকানো যাক। বর্তমান সময়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি। সেখানে যে মাহিন্দা রাজাপক্ষে ‘উন্নয়নের গালগল্পে’ নিজেকে প্রায় ‘অবিকল্প’ ঘোষণা করেছিলেন, সেই তিনি এখন বিক্ষোভের মুখে সাবেক বনে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী। যে রাজাপক্ষে পরিবার দেশটির ভাগ্যবিধাতা হয়ে বসে ছিল দীর্ঘদিন, তার শেষ সদস্য হিসেবে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষেকে বিক্ষোভের মুখেই প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ ছাড়তে হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, মাহিন্দা রাজাপক্ষকে প্রতিস্থাপন করা রনিল বিক্রমাসিংহেও পদত্যাগের পথে। সুতরাং দেখাই যাচ্ছে, শ্রীলঙ্কায় ‘বিকল্পহীন’ শব্দটি ছিল এক মিথ কেবল।
একই খেলা চলছে এখন আর্জেন্টিনায়। পরিস্থিতি বিচারে তা শ্রীলঙ্কার মতোই। মূল্যস্ফীতি, বিদ্যুৎ নেই, জ্বালানি নেই, চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত ওষুধের সরবরাহ নেই, কারণ রিজার্ভ ঘাটতির কারণে আমদানি বাধাগ্রস্ত। সেখানেও বিক্ষোভ চলছে। তাদের লক্ষ্য শ্রীলঙ্কার মতোই প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ। আগে বলা প্রবণতার কথা ধরে এই আশঙ্কা জাগা তাই খুব স্বাভাবিক যে—দেশে দেশে হালের বিক্ষোভকারীদের মধ্যে রাষ্ট্রের শীর্ষ ক্ষমতাধর ব্যক্তির আবাসস্থল ঘেরাও কি তবে গণপ্রবণতায় রূপ নিচ্ছে! এ ধরনের প্রবণতা এর আগে দেখা দিয়েছিল ২০১০-এর পর আরব বসন্তের হাত ধরে। সে-ও ছিল মন্দাকাল। সে সময় বিক্ষুব্ধ জনতা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে নিজ নিজ দেশের চালু চত্বরগুলোয় জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করত। এই প্রবণতার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী রাষ্ট্র এখন সিরিয়া।
সে যাক, প্রবণতার গল্পে ঢুকে লাভ নেই; বরং ‘বিকল্পহীন’ বিষয়টিতে ফেরা যাক আবার। কথায় কথায় ‘বিকল্পহীন’ ঘোষণা করাটা শুধু আমাদের আবেগময় জাতির মধ্যেই নেই। আরও অনেক জাতির মধ্যেই আছে। এটা মূলত ওপর থেকে নিচের দিকে গড়িয়ে পড়া এক ধারণা। কীভাবে? সে ব্যাখ্যায় যাওয়ার আগে ‘বিকল্প’ শব্দটি একটু বোঝা দরকার।
- ট্যাগ:
- মতামত
- রাজনৈতিক অস্থিরতা
- রাষ্ট্রক্ষমতা