৫০ বছরে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি

সারাক্ষণ জাকারিয়া স্বপন প্রকাশিত: ২৮ মার্চ ২০২১, ১২:১৪

দেখতে দেখতে বাংলাদেশ ৫১ বছরে পা দিল। বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে যাদের জন্ম হয়েছে, তাদের হয়তো ১০০ বছর পূর্তি দেখার সৌভাগ্য হবে না; তবে যদি কারো জীবনে সেটা হয়ে যায়, তাহলে চমৎকার একটি বিষয় ঘটবে। কিংবা এখন যার জন্ম হলো, সে যখন বাংলাদেশের ১০০ বছর নিয়ে লিখবে, তখন পেছনের ৫০ বছর আর তার নিজের ৫০ বছর নিয়ে দুই জীবন লিখতে পারবে। ইতিহাসের পরিক্রমায় আমি আমার দেখা গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির পরিবর্তনটুকু লিখে যাচ্ছি।

বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে মোট তিনটি দশকে ভাগ করে দেখা যেতে পারে। তাহলে ইতিহাসের কাঠগড়ায় আমাদের অবস্থান বুঝতে সহজ হবে।

নব্বইয়ের দশক

বাংলাদেশ মূলত তথ্যপ্রযুক্তি খাতে প্রবেশ করে নব্বইয়ের দশকে। এর আগে বাংলাদেশে আইবিএম মেইনফ্রেম কম্পিউটার ছিল। সেটা বিশেষ গবেষণার কাজে ব্যবহৃত হতো। সাধারণ মানুষের, কিংবা সরকারের বড় কোনো কাজে সেগুলো ব্যবহৃত হতো না। তাই আমি শুরুটা করছি নব্বইয়ের দশক থেকেই।

এই দশকে এসে বাংলাদেশ তার প্রথম কম্পিউটার গ্র্যাজুয়েট বের করতে শুরু করে। বুয়েট থেকে তখন কম্পিউটার বিজ্ঞানে স্নাতক বের হতে শুরু হয়। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় যুক্ত হয়। দেশে যথেষ্টসংখ্যক লোকবল না থাকলে তো আর সেই ক্ষেত্রটি বেড়ে ওঠে না। সেই হিসাবে বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তি খাতে পা রাখতে শুরু করে।

সারা পৃথিবীতেও তখন পারসোনাল কম্পিউটারের ব্যবহার বাড়তে থাকে। বাংলাদেশেও তার ছোঁয়া লাগতে শুরু করে। আশির দশকে বাংলাদেশে কম্পিউটার কাউন্সিল গঠিত হলেও এর কাজে কিছুটা গতি আসে নব্বইয়ের দশকে এসে। তখন তারাই মূলত বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে চালিত করত।

এই সময়ে বাংলাদেশে দুটি বিষয় ঘটল- ক) ভি-স্যাটের মাধ্যমে অনলাইন ইন্টারনেট প্রবর্তন, খ) মিলেনিয়াম পরিবর্তন (১৯৯৯ থেকে ২০০০ সালে প্রবেশের জন্য প্রস্তুতি)।

তখন খুব স্বল্পমাত্রায় বাংলাদেশের মানুষ চড়া দামে অনলাইন ইন্টারনেট পেতে শুরু করল। মূলত টেলিফোন লাইনের মাধ্যমে ডায়াল করে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হওয়া। পাশাপাশি পুরো পৃথিবীতে ডেটা এন্ট্রি করার বিশাল একটি বাজার তৈরি হলো, যা ভারত নিয়ে নিল। বাংলাদেশ ওই বাজারে প্রবেশ করতে পারল না। এর মূল কারণ ছিল, বাংলাদেশ তখনো ওই বাজার ধরার জন্য প্রস্তুত ছিল না। ভারত আশির দশকেই যেভাবে তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে গুরুত্ব দিয়ে প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিল, সেটা বাংলাদেশ পারেনি। ফলে বিলিয়ন ডলারের পুরো ব্যবসাটাই চলে যায় ভারতে।

ওই দশকে বাংলাদেশ বিনা মূল্য সাবমেরিন কেবলে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল, যা তখন সরকার নেয়নি। তারা মনে করেছিল, সাবমেরিন কেবলে যুক্ত হলে সব তথ্য পাচার হয়ে যাবে। আমরা যে এভাবে ভাবতে পেরেছিলাম, সেটা একটা জাতির অনেক কিছু বলে দেয়। এতে দেশের মানুষের মনস্তত্ত্ব বোঝা যায়। এই মনস্তত্ত্ব নিয়ে এই দেশ তথ্যপ্রযুক্তিতে ভালো করবে, সেটা বোধ করি সম্ভব নয়। তথ্যপ্রযুক্তিতে যে দেশগুলো ভালো করেছে, তাদের মনস্তত্ত্ব ভিন্ন। তার সঙ্গে আমাদের ফারাক অনেক। এতটাই ফারাক যে, আমরা সেটা বুঝতেই পারব না।

গত শতকে বাংলাদেশ যা পেতে পারত, সেটা আর হলো না। ওই সুযোগটুকু ধরতে পারলে পরবর্তী দশকগুলো আরো ভালো হতো। বাংলাদেশ তখনো তথ্যপ্রযুক্তি খাতে হাঁটতে শেখেনি।

একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক

এই দশকে বাংলাদেশে ইন্টারনেটের ব্যবহার কিছুটা বেড়েছিল। পুরো বিশ্বেই তখন ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ছে। এবং ইন্টারনেটের উত্থান ওই সময়টাতেই। সিসকোর মতো বিশাল প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছিল শুধু ইন্টারনেটের গ্রোথ সামনে রেখে। ওই প্রতিষ্ঠানটি তখনই ট্রিলিয়ন ডলারের কোম্পানি হবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

এই দশকের সবচেয়ে বড় প্রযুক্তি ছিল ভয়েস অভার আইপি (ভিওআইপি)। পুরো বিশ্ব যখন এই প্রযুক্তিকে বুকে জড়িয়ে নিচ্ছে, তখন বাংলাদেশ এই প্রযুক্তিকে নিষিদ্ধ করে দিল। তারা মনে করল, এর ফলে আন্তর্জাতিক ভয়েস কলের মুনাফা কমে যাবে। এই প্রযুক্তিটিকে আটকে দিল বাংলাদেশ। এবং এখনো নিষিদ্ধ হয়ে আছে।

ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলো এই প্রযুক্তিকে কাছে টেনে নিল, তখন এই প্রযুক্তির ব্যবহারে বাংলাদেশ যুক্ত হলো না। দেশের মানুষকেও যুক্ত করল না। ইউরোপের একটি ছোট দেশ এস্টোনিয়ার চারজন প্রোগ্রামার তৈরি করে ফেলল স্কাইপ। এই উদাহরণটুকু এ জন্য দিলাম যে, প্রযুক্তিকে উন্মুক্ত রাখলে মানুষ কতটা ক্রিয়েটিভ হতে পারে, মানুষ কতটা জ্ঞানের দিক থেকে এগিয়ে যেতে পারে, সেটা বোঝানোর জন্য। সেই স্কাইপ আমরা এখনো ব্যবহার করছি। স্কাইপ হলো একটি উদাহরণমাত্র। কিন্তু স্কাইপের মতো এমন অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছিল, যেগুলো পরবর্তী সময়ে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিশাল অবদান রেখেছে। আমরা এখন যেমন হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ইমো, ম্যাসেঞ্জার, সিগনাল ইত্যাদি কমিউনিকেশন প্ল্যাটফর্ম দেখি, তার গোড়াপত্তন হয়েছিল এই দশকে ভিওআইপি প্রযুক্তির মাধ্যমে। একটি প্রযুক্তিকে আটকে দিলে কী হয়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো এটি।

বিশ্বের অনেক দেশ তার জনসংখ্যাকে তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত করে ফেলেছিল, যার সুবিধা তারা এখনো পাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ সেটা পারেনি। সে আটকে গিয়েছিল তথ্যপ্রযুক্তিকে বাধা দিতে গিয়ে। একটি জাতিকে কীভাবে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে প্রস্তুত করতে হয়, সেটা সে বুঝতে পারেনি। ওই প্রযুক্তিকে উন্মুক্ত করে রাখলে বাংলাদেশের জনগণ এখন অনেক বেশি প্রস্তুত থাকত। অনেক বেশি আউটপুট দিতে পারত। বাংলাদেশ সেই ভিশন দেখাতে পারেনি।

একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক

খুব নির্মোহভাবে যদি বলি, তাহলে গত দশক থেকেই আসলে বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত হতে শুরু করেছে। সরকার তার অনেক সেবা সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে চেষ্টা করেছে। পাশাপাশি এ খাতটি একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

গত দশকের শুরুতে ইন্টারনেটের ব্যবহার যতটা ছিল, সেটা অনেকাংশে বেড়েছে দশকটির শেষভাগে এসে। তবে বাংলাদেশ এই ব্যবহারকারী আগের দশকেই পেতে পারত, যদি সে সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারত।

এই দশকে বাংলাদেশের মানুষ প্রাইভেট সেক্টরেও সেবা পেতে শুরু করেছে। ইন্টারনেটভিত্তিক সেবা, ডিজিটাল পেমেন্ট, ই-কমার্সগুলো আসতে শুরু করে- যেগুলো পৃথিবীর অনেক দেশ আরো ২০ বছর আগেই করে ফেলেছে। অর্থাৎ আমরা অন্তত ২০ বছরে পিছিয়ে থাকলাম।

আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা নিজেদের চেষ্টায় ফ্রিল্যান্সিং কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাংলাদেশে বসে বিশ্বের উন্নত দেশের কাজ করতে শুরু করে। তবে বিদেশ থেকে টাকা আনা নিয়ে হাজারো ঝক্কি পোহাতে হয়েছিল, যেগুলো এখন অনেকটাই ঠিক হয়ে এসেছে। কিন্তু এগুলোও আরো ১০ বছর আগেই ঠিক হয়ে যেতে পারত। শুধু নীতিগত কারণে পিছিয়ে যাওয়া। তারপরেও বলব, বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সিং ক্ষেত্রে বেশ ভালো একটি জায়গা করে নিয়েছে। এই কাজটিতে বাংলাদেশ আরো ভালো করতে পারত যদি সে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেটের ভালো গতি পৌঁছে দিতে পারত, এবং ডিজিটাল পেমেন্টটাকে সহজতর করতে পারত।

এই দশকেও বাংলাদেশ তার ইন্টারেনেটের গতি ঠিক করতে পারেনি। বাংলাদেশের মানুষ দুই উপায়ে ইন্টারনেট পেয়ে থাকে। একটি হলো ফাইবার অপটিক ব্রডব্যান্ড, আরেকটি হলো মোবাইল ইন্টারনেট। বাংলাদেশে পরিকল্পিত উপায়ে ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠেনি। ঢাকার চেয়ে জেলা শহরগুলোতে ইন্টারনেটের গতি কম এবং মূল্য বেশি। বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত এখনো ঢাকাকেন্দ্রিক। ঢাকায় কিছু কিছু এলাকা ফাইবারের আওতায় এসেছে। কিন্তু সেগুলো আন্তর্জাতিক মানের নয়।

আর মোবাইল ইন্টারনেটের অবস্থা যে ভয়াবহ খারাপ, সেটা তো আমরা সবাই জানি। ঢাকা শহরের মানুষ কিছুটা গতি পেলেও ঢাকার বাইরের অবস্থা খুবই নাজুক। এটা মূলত হয়েছে মোবাইল অপারেটররা ঢাকার বাইরে তেমন বিনিয়োগ করেনি, যা তাদের লাইসেন্সের আওতায় করার কথা। এবং বাংলাদেশ যেহেতু এটাকে নিশ্চিত করতে পারেনি, তাই দেশ আরো ১০ বছরের বেশি সময় পিছিয়ে গেল। ভারতের একটি অজপাড়াগাঁয়ে বসে মানুষ যেভাবে লাইভ করতে পারে, বাংলাদেশের মানুষ সেটা জেলা শহরেই পারে না।

তথ্যপ্রযুক্তি খাত প্রাইভেট সেক্টরে প্রসারিত হওয়ার জন্য যে ইনফ্রাস্ট্রাকচারের প্রয়োজন ছিল, তা তৈরি হয়নি। ফলে দেশে বড় কোনো সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি।

সারাংশ

বাংলাদেশ এখনো তথ্যপ্রযুক্তি খাতে হাঁটি হাঁটি করছে। আমাদের কোটি কোটি মোবাইল গ্রাহক আছে বটে। কিন্তু তারা মূলত ভয়েস কল করার জন্যই এটাকে ব্যবহার করে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এমন একটি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়নি, যেখানে ২০ জন আন্তর্জাতিক মানের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার আছে। এই সামান্য একটি তথ্যই অনেক কিছু বলে দেয়।

বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের তিনটি চ্যালেঞ্জ। প্রথমটি হলো উন্নত মানের ইন্টারনেট, যা আরো ২০ বছর আগেই সমাধান হওয়া দরকার ছিল। দ্বিতীয়টি হলো উন্নত বুদ্ধির মানুষ। তথ্যপ্রযুক্তি হলো এমন একটি খাত, যেখানে বুদ্ধির প্রয়োজন হয়। এর জন্য চাই প্রকৃত বুদ্ধিমান মানুষ। কিন্তু বাংলাদেশ এখন বড় ধরনের ব্রেইন-ড্রেইনের ভেতর পড়ে গেছে। পৃথিবীর বড় বড় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে সরাসরি ভালো লোকগুলোকে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে সেবা তৈরি করার মতো মানুষ এ দেশে থাকছে না। আমরা মূলত কনজ‌্যুমার হচ্ছি। আমাদের যদি প্রস্তুতকারকের ভূমিকায় আসতে হয়, তাহলে আরো ব্রেইন লাগবে। আর তৃতীয়টি হলো ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি কপিরাইপ প্রটেকশন, যা বাংলাদেশে এখনো বেশ দুর্বল। মেধাস্বত্ব যদি সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা না যায়, তাহলে মেধাবীরা ওখানে থাকবে না। আর এই শিল্পে মেধার কোনো বিকল্প নেই।

লেখক: তথ্যপ্রযুক্তিবিদ

ই-মেইল: [email protected]

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

এই সম্পর্কিত

আরও