মোহাম্মদপুরের একটি বাড়ির ছাদবাগানে ইট-পাথরের তৈরি চৌবাচ্চা (লাল কালিতে চিহ্নিত)। ছবি: প্রিয়.কম
এডিসের বংশবিস্তার রোধে রাজধানীবাসী কতটা সচেতন?
আপডেট: ৩০ জুলাই ২০১৯, ২০:২০
(প্রিয়.কম) রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডের একটি আবাসিক ভবনের চারতলার ছাদে বেশ সুন্দর বাগান। সেখানে রয়েছে বিভিন্ন ফুল ও ফলের গাছ। এসবে পানি দেওয়ার জন্য ছাদের একপাশে রয়েছে পানি ধরে রাখার একটি চৌবাচ্চা। ইট-সিমেন্টের তৈরি সেই চৌবাচ্চায় সাধারণ সময়ে ট্যাংকি থেকে পানি নিয়ে জমানো হয়। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে সেখানে পানি আলাদা করে নেওয়ার প্রয়োজন হয় না; বৃষ্টির পানিই জমে থাকে। চৌবাচ্চায় জমে থাকা পানিতে এডিস মশার জন্ম হতে পারে—এমন কথা জানালেও বাগান ও বাড়ির মালিক নির্বিকার। তিনি কোনো উদ্যোগ নেননি। বলেছেন, তাতে তিনি মাছ ছেড়েছেন, কিছু করা যাবে না।
নূরজাহার রোডের সেই বাসার পাশের বাসার একটি ফ্ল্যাটে থাকেন আফসানা রহমান, যিনি ওই বাসার মালিককে সচেতন হওয়ার বিষয়টি জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। আফসানা বলেন, ‘আমি এতো করে বললাম, সারা দেশে ডেঙ্গুতে মানুষ মরছে, আপনারা চৌবাচ্চাটি প্রতিদিন পরিষ্কার করবেন। জমে থাকা পানি ফেলে দেবেন কিংবা এজন্য ব্যবস্থা নিন। কিন্তু উনার কোনো প্রতিক্রিয়াই নেই। ভয় তো আমাদের। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে বাসায় থাকি। কখন কার ডেঙ্গু হয়। আমি তো জানালা খোলাই বন্ধ করে দিয়েছি।’
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের দোষ দিয়ে কী করব বলেন। মানুষ যদি সচেতন না হয়, এরা তো শিক্ষিত মুর্খ।’
প্রতিটি বাসাবাড়ির ছাদে পানি জমে কি না, পানি জমার চৌবাচ্চা আছে কি না, তা সিটি করপোরেশনের পরীক্ষা করা এবং পেলে জরিমানা করার দাবি জানান আফসানা রহমান। তার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন পাশ থেকে সুলতানা নামের একজন এই প্রতিবেদককে ডেকে নিয়ে গেলেন তাদের ফ্ল্যাটে। তিনি দেখালেন, পাশের তিনতলা ভবনের ছাদের ওপরে প্রায় পুরোটাতে জমে আছে বৃষ্টির পানি।
সুলতানা বলেন, ‘ওই বাসায় যারা থাকেন, তাদের জানানো হয়েছে পানি যেন না জমে। ব্যবস্থা নিবেন বললেও কোনো কিছু হয়নি। এডিস মশার জন্মের জন্য এই পানির চেয়ে ভালো জন্মস্থান হয় না।’
ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার একজন বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম। নিজের বাড়ি নেই, ভাড়ায় থাকেন। তিনি বলেন, ‘আমি যে ফ্ল্যাটে থাকি, বৃষ্টি হলে সেই ভবনের ছাদে একটু পানি জমত। পরে বাড়ির মালিককে জানানোর পর তিনি ব্যবস্থা নিয়েছেন। এখন আর পানি জমে না।’
বাড়ির মালিকদের সচেতন হওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন শফিকুল ইসলাম।
ঢাকার অনেক বাড়ির ছাদের চিত্রই এমন। যেখানে বৃষ্টির পানি জমে থাকছে কিংবা ছাদবাগানের চৌবাচ্চা বা টবে পানি জমছে। আর এডিস মশার বংশবৃদ্ধিতে এসবই হচ্ছে উপযুক্ত স্থান। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন জনসচেতনতা তৈরির চেষ্টা করলেও তা আসলে কতটা কার্যকর হচ্ছে? সাধারণ মানুষ কতটা সচেতন হচ্ছেন?
প্রতি বছরই বর্ষায় ডেঙ্গুর দেখা মিললেও চলতি বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ১৪ হাজারেরও বেশি; বেসরকারি হিসাবে মারা গেছেন ৩৯ জনের মতো, যদিও স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাবে তা চার ভাগের এক ভাগ।
৩০ জুলাই, মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ডেঙ্গুর বিষয়ে সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। মশার বংশবিস্তার রোধে ঘরবাড়ির চারপাশটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে বলেছেন তিনি। কোথাও যেন বৃষ্টির পানি জমে না থাকে সে বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকতে বলেন প্রধানমন্ত্রী।
মশার ওপর গবেষণা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। তিনি মনে করেন, এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি, তবে ডেঙ্গু থেকে নিজেদের রক্ষায় সচেতনতার বিকল্প নেই। এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি বলেন, চলতি বছর থেমে থেমে বিরতি নিয়ে বৃষ্টি হয়েছে। এভাবে বৃষ্টি হওয়াতে সহজেই পানি জমে থাকছে এবং এডিস মশা সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে বাসাবাড়ির ছাদে। অনেকেই শখের বসে ছাদে বাগান করছেন। গাছের টব ও চৌবাচ্চায় বৃষ্টির পানি জমে থাকছে। আবার অপরিকল্পিতভাবে তৈরি নগরের বেশিরভাগ ছাদেই বৃষ্টি হলে পানি জমে থাকে। পরিষ্কার এই পানিতে এডিস মশার লার্ভা তৈরি হয়। পরে এই পানি শুকিয়ে গেলেও লার্ভা জীবিত থাকে এবং সেখান থেকেই এডিস মশার জন্ম হয়।
এই অধ্যাপক জানান, ঢাকার অনেক এলাকায় সবসময় ওয়াসার লাইনে পানি থাকে না। ফলে যখন পানি থাকে, তখন অনেকেই ড্রাম বা কোনো পাত্রে পানি ধরে রাখেন। প্রতিদিন সেই ড্রামে পানি রাখলেও তা নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না। এতে সহজেই এডিস মশা লার্ভা সৃষ্টি করতে পারছে। এ ছাড়াও ঢাকায় সারা বছরই ভবন নির্মাণ হয়। এসব নির্মাণাধীন ভবনের কাজ চলে কয়েক বছর ধরে। অনেক সময় ফ্ল্যাট বিক্রি না হওয়ায় এটার সময় আরও বৃদ্ধি পায়। সেক্ষেত্রে এসব নির্মাণাধীন ভবনে ইট ভেজানোর জায়গা থাকে, লিফটের জন্য গর্ত থাকে, ভবনের বিভিন্ন তলায় দেওয়া পানি জমে থাকে। এসব কারণে প্রচুর মশার জন্ম হচ্ছে।
কবিরুল বাশার বলেন, ‘এডিস মশাকে বলা হয় গৃহপালিত মশা। এটা আমাদের আশপাশে পরিষ্কার পানিতে হয়। এজন্য পানির পাত্র, ফুল বা গাছের টব, ছাদে পানি জমে থাকতে দেওয়া যাবে না। এডিস মশার বংশবৃদ্ধি রোধে মানুষের পার্টিসিপেশনটা খুব জরুরি।’
শুধু সিটি করপোরেশনের পক্ষে এডিস মশাকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি।
কিন্তু কতটুকু সচেতন হচ্ছেন নগরবাসী? শান্তিনগর এলাকায় নির্মাণাধীন দুটি ভবনকে সচেতন হতে চিঠি দিলেও কোনো কাজ হয়নি। পরে মঙ্গলবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) সেখানে অভিযান চালায় এবং জরিমানা করা হয় বলে জানান সংস্থাটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ শরীফ আহমেদ।
তিনি বলেন, এতোকিছুর পরেও যারা সচেতন হচ্ছে না, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। নির্মাণাধীন ভবনসহ বাসা-বাড়িতেও অভিযান চালানো হচ্ছে।
মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, সম্প্রতি এডিস মশা বাড়ায় দক্ষিণ সিটির ৫৭টি ওয়ার্ডে মশক নিধন কার্যক্রম চলমান। যতক্ষণ পর্যন্ত এগুলো নির্মূল না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা বসে থাকতে পারি না। তবে কিছু বাড়ির মালিক আছেন যারা এ বিষয়ে কোনোরকম সতর্ক না, তাদের কারণে আমাদের কাজ আরও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমরা নির্মাণাধীন বাড়ি চিহ্নিত করেছি, তবে সব ভবনে এডিস মশার লার্ভা নেই। তাছাড়া আমরা সব জায়গায় যাওয়ার চেষ্টা করছি। আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গাফিলতি ছিল, সেগুলো কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছি। প্রধানমন্ত্রী আমাদের এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, সেভাবে কাজ হচ্ছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোমিনুর রহমান মামুন দাবি করেন, মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য লিফলেট বিতরণ, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন, র্যালি, মসজিদের ইমামদের চিঠিসহ বিভিন্ন কাজ করা হচ্ছে।
প্রিয় সংবাদ/রুহুল