
ছবি সংগৃহীত
অ্যাজমা আক্রান্ত ব্যক্তি ও ডাক্তারের মতামত
আপডেট: ০২ মে ২০১৭, ১১:৩৭
অ্যাজমা আক্রান্ত রোগি। ছবি সংগৃহীত।
(প্রিয়.কম) আজ বিশ্ব অ্যাজমা দিবস। প্রতিবছর মে মাসের প্রথম মঙ্গলবার, বিশ্ব জুড়ে পালিত হয় এ দিবসটি। সারাবিশ্বে বর্তমানে অ্যাজমা রোগির সংখ্যে ১৫ কোটিরও বেশি! বাংলাদেশে এই রোগির সংখ্যা প্রায় ৭০ লক্ষ, যার মধ্যে ৪০ লক্ষই শিশু। শ্বাসনালীর অতি সংবেদনশীলতা জনিত দীর্ঘমেয়াদী অ্যাজমা রোগ স্বাভাবিক শ্বাস প্রশ্বাসকে ব্যাহত করে। কিন্তু এর সঠিক কারণ আজ পর্যন্ত অজানা। এ রোগ থেকে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করা সম্ভব নয়। তবে সঠিক চিকিৎসা পেলে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা সম্ভব। ১৯৯১ সালে ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় অ্যাজমা নিয়ন্ত্রণে ‘গাইড লাইন্স’ ভিত্তিক চিকিৎসা শুরু হয়। এটি একটি অতি সনাতনধর্মী নীতিভিত্তিক পদ্ধতি। সর্বপ্রথম ১৬৮৬ সালের দিকে বেবিলনের রাজা হামুরাবি চিকিৎসা শাস্ত্রে এ নীতি প্রণয়ন করেছিলেন। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত চিকিৎসকেরা এ রোগে আক্রান্ত মানুষের সেবার উদ্দেশ্যে অসংখ্য নীতিমালা বাস্তবায়ন ও প্রণয়ন করেছেন। অ্যাজমার নীতিমালা রোগীর রোগটিকে নিয়ন্ত্রণ করে রোগির জন্য একটি স্বাভাবিক জীবন যাপন সম্ভব করে তুলেছে। আমাদের দেশে এ রোগে আক্রান্ত রোগিদের ভোগান্তি অনেক। পাশাপাশি কিছু কুসংস্কার তো রয়েছেই। ঢাকা ও মফস্বলে বসবাসরত দু’জন অ্যাজমা আক্রান্ত রোগির সঙ্গে কথা বললো প্রিয়.কম। এর মধ্যে একজন হচ্ছেন ‘শামীমা সীমা।’ তিনি বসবাস করেন ঢাকায় এবং ঢাকাতেই অ্যাজমা বিষয়ক চিকিৎসা করিয়ে থাকেন। আরেকজন হচ্ছেন রওশন আরা, তিনি গ্রামে বাস করেন। গ্রামের বিভিন্ন ওঝা ও কবিরাজের কথা মতো ওষুধ সেবন করেন রওশন আরা। ঢাকায় এসেও একবার চিকিৎসা করিয়েছেন তিনি। আজ বিশ্ব অ্যাজমা দিবস উপলক্ষ্যে, বিপরীত মেরুতে বসবাস করা এ দু’জন অ্যাজমা আক্রান্ত রোগীর অভিজ্ঞতার বর্ণনা তুলে ধরা হলো। সঙ্গে থাকছে একজন ডাক্তারের মতামত।
শামীমা সীমা: আমার বয়স যখন তিন বছর। তখন থেকেই আমি অ্যাজমা নামক রোগে আক্রান্ত হই। আমার এই অসুখটা জন্মগত নয়। তিনবছর বয়সে আমি সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে শরীরের বাম অংশে ব্যথা পাই। চিকিৎসকেরা আমার হাতের ব্যথাটিই শুধু লক্ষ্য করে, এবং হাত প্লাস্টার করেই ছেড়ে দেয়। এর কিছুদিন পর থেকে আমি শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যা অনুভব করতে থাকি। একটা সময় অসুখটি বাড়াবাড়ি পর্যায়ে গেলে আমাকে ভেন্টোলিন নামক ট্যাবলেটের আশ্রয়ে যেতে বলে চিকিৎসক। কিন্তু এটি আমাকে আরও দুর্বল করে দেয়। এভাবেই চলছিল আমার জীবন। একসময় আমার এক কাজিন আমাকে জানায়, ইনহেলারের মাধ্যমে কিছুটা আরাম পাওয়া যায়। পরে আমি ডাক্তারের কাছ থেকে ইনহেলার নিই, এবং ব্যবহার করতে শুরু করি। এর মধ্যে অক্সিজেন, নেবুলাইজারও চলতে থাকে। প্রায় ১৫ বছর যাবত ইনহেলার ব্যবহার করার কারণে আমার অ্যাজমা এখন নিয়ন্ত্রণে। আমার অবস্থা হয়তো এত সিভিয়ার লেভেলে যেত না, যদি না আমার তিন বছর বয়সেই আমার ফুসফুসের সঠিক চিকিৎসা হত। আমার ফুসফুস এখনও দুর্বল। শুধুমাত্র হাই ডোজের ইনহেলার ও নিয়মিত ওষুধ সেবনের কারণে আমি কিছুটা সুস্থ আছি।
এছাড়াও ভুল চিকিৎসার সম্মুখীন হন আমার বাবা। আমার বাবা অনেকদিন ধরে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি জনিত সমস্যায় ভুগতে থাকেন। কিন্তু চিকিৎসকেরা এই রোগ সম্পর্কে কোনো ধারণা দিতে পারেন না। ভয়াবহ শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে তারা অক্সিজেন দিয়ে চিকিৎসা করত। আমরা বুঝতে পারি, তার চিকিৎসা অক্সিজেনে, তাই আমরা বাড়িতে অক্সিজেনের মেশিন কিনে নিয়ে আসি। সঙ্গে চলতে থাকে প্রচুর ওষুধ ও ইনহেলার। কিন্তু ধীরে ধীরে আমার বাবার অবস্থা অবনতির দিকে যেতে থাকে। আমার বাবার ফুসফুসে টিউমারের কারণে তিনি অ্যাজমা রোগীতে পরিণত হন, সেটি আমরা জানতে পারি যখন তার বয়স যখন প্রায় ৬৫। এই দেশে নয়, ভারতের চিকিৎসকেরা এই টিউমারের অস্তিত্ব জানতে পারেন। এরপর আমাদের আর কিছুই করার ছিল না। সেই টিউমার ধীরে ধীরে ক্যান্সারে রূপ নেয়। ফুসফুস দুর্বল হওয়ার কারণে আমার বাবার শ্বাসকষ্ট এবং নিউমোনিয়া লেগেই থাকত। শ্বাসকষ্টের কারণে আমার বাবা তিনবার আইসিইউতে লাইফ সাপোর্ট নিতে বাধ্য হন। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। গতবছর লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় আমার বাবা মারা যান।
এখানে আমার কিছু বলার আছে। আমি এবং আমার বাবা যদি সময় মত সুচিকিৎসা পেতাম, হয়ত আমাদের এত ভুগতে হতো না। আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে ভালো। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তারা রোগটি সঠিকভাবে ধরতে পারেন না। যে কারণে আমাদের দ্বারস্থ হতে হয় বাইরের চিকিৎসা ব্যবস্থার কাছে। মাঝেমধ্যে রোগ ধরতে পারলেও ওষুধ দেয়ার ক্ষেত্রে কিছু ভুল থেকেই যায়। এতে রোগি আরও দুর্বল হয়ে পড়েন। একসময় দেখা যায়, দুর্বলতার কারণে রোগি আরও বেশি সুস্থ হতে পারেন না। আরেকটি বিষয় রয়েছে। আমাদের দেশের ডাক্তার রোগিদের অসুখের বর্ণনা বলে ভয় পাইয়ে দেন, যা মোটেও উচিত নয়। যদি তারা রোগ ধরতে না পারেন, তাদের উচিত সেটি বলে দেয়া। এমন হয়রানির কারণে হাজারো মানুষ বাইরের চিকিৎসা নিতে বাধ্য হচ্ছেন।
রওশন আরা: আট থেকে নয় বছর ধরে অ্যাজমা রোগে ভুগি। আমার বাবা মায়ের অ্যাজমা নাই কিন্তু আমার তৃতীয় সন্তান জন্মানোর পর থেকে আমি এই রোগে আক্রান্ত। গ্রামে ছোট ছোট ডাক্তার দেখাইয়া ওষুধ খাইছি, কমে নাই। কবিরাজের থেইকা তাবিজ আনছি। ‘তেল পড়া’ দিছিল, সেইটা বুকে ডলছি, অসুখ কমে নাই। আরেকজন কবিরাজের কাছ থেইকা ‘মিশ্রি পড়া’ আইনা একমাস খাইছি, কমে নাই। শুনছিলাম ছাগলের দুধ খাইলে এই রোগ কমে, সেইটা খাইয়াও রোগ কমে নাই। পরে ঢাকায় গিয়া একটা হাসপাতালে চিকিৎসা নিছি কিন্তু তাতেও কোনো ফল পাই নাই। পরে বরিশালের একজন ডাক্তার, তিনি হাসপাতালের না, একটা চেম্বারে বসেন। উনারে দেখাইলাম। উনি ওষুধ দিলেন, সেইটা খাইয়া একটু ভালো হইছিলাম। যখন শ্বাস কষ্ট ওঠে তখন অনেক খারাপ লাগে, শরীর ঘামাইয়া যায়, শ্বাস বন্ধ হইয়া আসে। ভারি কাজ করলে শ্বাস কষ্ট ওঠে। কিছুক্ষণ বইসা থাকলে ধীরে ধীরে কমে, তখন ভালো লাগে।
ইনহেলার। ছবি: সংগৃহীত।
অ্যাজমা প্রসঙ্গে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এম,ও 'ডা.আশিক মাহামুদ'এর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন- ‘এই রোগটি তো অনেকটাই ‘জেনেটিক ডিজঅর্ডার’ তাই এর থেকে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করা কম। আমাদের দেশের রোগিরা এ নিয়ে হতাশায় ভোগেন, কেন সম্পূর্ণ সেরে উঠছেন না, কেন আরোগ্য হচ্ছে না- এবিষয়ে তাড়াহুড়া কাজ করে তাঁদের মধ্যে। কিন্তু অ্যাজমা মূলত কন্ট্রোল করার বিষয়। অনেক সময় অ্যাকিউড এক্সাজারেশন অফ ব্রংকিয়াল অ্যাজমা পরিস্থিতে চলে যেতে পারে, তখন হার্ট কিংবা দেহের অন্য কোনো অর্গান ফেইল করে রোগি মারা যেতে পারে। আমাদের দেশে বক্ষব্যধি চিকিৎসালয়ের সংখ্যা নগণ্য। আর অ্যাজমা নির্মূল করার ওষুধ আবিস্কার করা নিয়ে আমাদের দেশে এবং দেশের বাইরে কিছু গবেষণা চলছে। আমার জানামতে ইউ,কে-তে গবেষণা হচ্ছে। আমাদের দেশে অ্যাজমা সম্পর্কে কিছু মিথ প্রচলিত আছে, যেমন-কেউ যদি বলে ছাগলের দুধ পান করলে অ্যাজমা কমে যাবে- সেটা ভুল। চিকিৎসা বিজ্ঞানে অ্যাজমার ওষুধ হিসেবে ছাগলের দুধ পান করা আমি দেখিনি’।
যা হোক, অ্যাজমার মতো একটি দীর্ঘ মেয়াদী রোগের সুচিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রম জোরদার করা হয় বিশ্ব অ্যাজমা দিবসে। দেশ বিদেশের নানান চিকিৎসালয়ে এ দিন এই উপলক্ষ্যে নানা ধরনের কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। পরিকল্পিত চিকিৎসার মাধ্যমে মারাত্মক ও জটিল অ্যাজমা রোগ এড়ানো সম্ভব।
সম্পাদনা: গোরা