সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ভালো, নাকি মন্দ

যুগান্তর পিনাকী ভট্টাচার্য প্রকাশিত: ০৪ জুলাই ২০২৫, ১২:১৮

সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন এখন বাংলাদেশের হট টপিক। এটা বিএনপি ছাড়া সব দলই চায়। বিএনপি চায় না। বিএনপি কেন চায় না, আর অন্যরা কেন চায়, আমি নিশ্চিত অধিকাংশ মানুষ এটা বলতে পারবে না, এমনকি দলের কর্মীরাও বলতে পারবে না। আমার এটা বোঝার জন্য অনেক পড়াশোনা করতে হয়েছে। যা হোক, আজকে আমরা দেখব আসলে এ পদ্ধতি বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে কি না। রাজনৈতিক দলগুলো কী বুঝে চাচ্ছে, আর কী বুঝে বিরোধিতা করছে।


জামায়াত ১০ দফা প্রস্তাব দিয়েছে, ভালো কথা; কিন্তু এটার মধ্যে একটা খুব ইন্টারেস্টিং দফা আছে, তা হচ্ছে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন। এটার মানে কী? ধরেন আপনার আসনে মোট ভোট ১০ লাখ, মানে মোট ভোটার আর কী! তো ইলেকশন হলো, বিএনপি পেল ৫ লাখ, জামায়াত পেল ৩ লাখ। এটা তো পুরোই লস জামায়াতের জন্য। তারা বলছে, না ৩০০ আসনে যত ভোট পড়বে, সেই ভোট মোট ভোটের যত শতাংশ, ৩০০ আসনের তত শতাংশ সিট তাদের দিতে হবে। তার মানে, কোনো সিটে আলাদাভাবে যারা জিতছে না, তারা যদি সব মিলে এক পারসেন্ট ভোটও পায়, তাহলে তারা তিনটা সিট পাবে। যদি আধা পারসেন্ট পায়, তাহলেও একটা সিট অন্তত পাবে। ছোট দলের জন্য খারাপ না, সিট বাড়ে এতে। ইউরোপের অনেক দেশে এ সিস্টেম আছে। তাই ন্যাশনাল পলিটিক্সে ছোট দলের একটা ভয়েস আছে। তাহলে তো ভালোই, তাই না? পশ্চিমে তো অনেক কিছুই আছে রাজনীতিতে। আমরা জানি, পশ্চিমে সেকুলারিজম আছে। পশ্চিমে এলজিবিটিকিউ রাইটসের ইস্যু আছে। পশ্চিমে মদ খাওয়া, জুয়া-ক্যাসিনো আছে। আমাদের দেশের লোকেরা মেনে নেবে? তার মানে, পশ্চিমে আছে-এটা কোন সাফাই হতে পারে না। ছোট দলের জন্য এটা ভালো। জামায়াত কি ছোট দল, নাকি মনে করছে যে চিরজীবন সে ছোট দল থাকবে? ওই যে আছে না, সেকেন্ড ডিভিশনে খেলা; চিরজীবন সেকেন্ড ডিভিশনে খেলবে জামায়াত? আমরা দেখব এই ইস্যুটা আমাদের গ্রহণ করা উচিত কি না, করলে কেন উচিত, না করলে কেন উচিত না।


এখানে আরেকটা বিষয় যুক্ত করা দরকার। তা হচ্ছে, এই সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনে আপনি ক্যান্ডিডেটকে ভোট দেন না, মার্কায় ভোট দেন। এখন এই পদ্ধতি কেন দলগুলো চায়? আমি কোনো অনুমান করব না, আমি তাদের দলীয় ডকুমেন্ট থেকে দেখিয়ে দেব। আমি সব দলেরটা দেখাচ্ছি না; আমি জামায়াতেরটা দেখাই, কারণ জামায়াতই এই সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন চাওয়া সবচেয়ে বড় দল; তারা কী বলে এই দাবির পক্ষে আর্গুমেন্ট হিসাবে, আসেন সেটা একটু বুঝে দেখি।



জামায়াত একটাই যুক্তি দিচ্ছে এই সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের জন্য। নির্বাচনে টাকার খেলা বন্ধ করবে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন। আর কোনো দ্বিতীয় যুক্তি নেই। ক্যান্ডিডেটদের টাকা খরচ করতে হয়। টাকার খেলা বন্ধ করার জন্য জামায়াত সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন চায়, খুব সৎ চাওয়া, তাই না? আচ্ছা, জামায়াতের ভাইয়েরা বলেন তো, জাতীয় পার্টি তো ৭ শতাংশ ভোট পায়, তাই না? তার মানে তারা ২১টা সিট পাবে। ২১টা না পেলে ১৫টা পাবে, ১৫টা না পেলে ১০টা, ১০টা না পেলে ৫টা তো পাবে, নাকি? এর মধ্যে যদি সে একেকটা সিট ৫০০ কোটি টাকায় বিক্রি করতে চায়, হবে না বিক্রি? আপসে হবে, আওয়ামী লীগের লোকেরাই কিনে নেবে। মজা তো, এলাকায় যেতে হলো না, মারপিট করতে হলো না, ক্যাম্পেইন করতে হলো না, ভোটকেন্দ্র দখল করতে হলো না, এমনকি রাজনীতি করতে হলো না। আপনাকে এমনকি নমিনেশনও কিনতে হলো না। শোনা যায়, নমিনেশন দিয়ে অনেকে টাকাপয়সা নেয়। আপনার টাকা আছে, আপনার জেতা সিট কিনে নিলেন, নো রিস্ক, হারার কোনো ভয় নেই। ধরেন, দল এলাকা ভাগ করে দিল; বলল যে, এখন যে সিট আছে ওইভাবে ভাগ করবে। এই সিট অনুসারে, এই যে ধরেন বগুড়া, এখানে যত কেন্দ্র আছে, এখানে যদি বিএনপি জিতে, বিএনপি বলল যে তাহলে তোমাকে এমপি বানাব, ওই ক্যান্ডিডেট খরচা করবে না জেতার জন্য? পারবেন টাকার খেলা কমাতে? বরং বাড়িয়ে দেবেন টাকার খেলা। আরও কেন্দ্রীভূত করে দেবেন। কারণ ওই পাবলিককে জনগণ ভোট দেবে না, ওই পাবলিককে সিলেক্ট করবে দলের নেতা।


আর কী কী সমস্যা আছে? বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোতে তো অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র প্রায় অনুপস্থিত। নেতৃত্ব অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে দলীয় তালিকা তৈরি হবে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মাধ্যমে, এটা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিত্বকে দুর্বল করে দেবে। দলীয় নেতৃত্বের ক্ষমতা আরও কেন্দ্রীভূত করবে এবং স্থানীয় পর্যায়ে জবাবদিহিতা কমবে। দলের শীর্ষ নেতৃত্বই নির্ধারণ করবে কে সংসদে যাবে। ভোটারদের প্রত্যক্ষ ভোটের ক্ষমতা কমে যাবে। মানে এখন তো জনপ্রিয় নেতা হলে তার জেতার চান্স থাকে। মানুষের কাছে ভালো হতে হয়। সেটার কোনো দরকারই পড়বে না। দেখেন, আমরা অনেকে মনে করি, রাজনীতি মানে হচ্ছে, নির্বাচন, আইন, সংসদ-এ সবকিছু; কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মুশতাক খান একটা খুব সোজা কথা বলেন। তিনি বলেন, রাজনীতি আসলে একটা অদৃশ্য বোঝাপড়া। সেটাতে ঠিক হয় কে ক্ষমতায় থাকবে, কে টাকা খাবে, কে নিরাপদে থাকবে। এই বোঝাপড়াকেই বলা হয় পলিটিক্যাল সেটেলমেন্ট বা বাংলায় বলে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। এই রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ছাত্ররা ভাঙতে চেয়েছিল। আর সেটাকেই তারা বলছিল নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। এই বন্দোবস্ত লিখিত না। কিন্তু খুব বাস্তব। বড় বড় রাজনৈতিক দল, আমলা, ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, পুলিশ, বিচারক, এলিট-সবাই একটা অলিখিত চুক্তিতে থাকে।


আমি আরেকটু বুঝিয়ে বলি। ধরেন রাস্তার ট্রাকে চাঁদাবাজি, হাটের ইজারা, ছিনতাই, মস্তানি, ঠিকাদারি, বালুমহাল-এসব জিনিস আছে না, যেগুলোয় টাকাপয়সা আসে, এটার একটা ইকোনমি আছে-কে তুলবে টাকা, কে নেবে, পুলিশ কত পাবে, রাজনৈতিক নেতা কত পাবে, তৃণমূলের মাস্তান কত পাবে, মন্ত্রী কত পাবে, হাসিনা কত পাবে-এ সবকিছুই সেটেলড সেই অলিখিত চুক্তি দিয়ে। এ রাজনৈতিক বন্দোবস্তের অংশ এমপি। সে খরচা করে, মাস্তান পালে, কর্মী পালে, পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে, উকিলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে, স্থানীয় মাফিয়ার ওপরে, আন্ডারওয়ার্ল্ডের ওপরে নিয়ন্ত্রণ রাখে। এভাবেই এ বন্দোবস্ত টিকে থাকে। হাসিনা চলে যাওয়ার পরে অপরাধ বাড়ছে কেন? কারণ, এই আন্ডারওয়ার্ল্ডের ওপর যাদের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ছিল, তারা নাই হয়ে গেছে। এখন কেউ সেভাবে কন্ট্রোল করেন না, তাই এরা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে যা খুশি করছে। এটা ল অ্যান্ড অর্ডারের বিষয় না, এটা সেই অলিখিত চুক্তি ভেঙে যাওয়ার পরিণতি। আমাদের নতুন বন্দোবস্ত করার আগেই আপনি আরেকটা বন্দোবস্ত আনছেন। বাংলাদেশে ইনস্টিটিউশন নেই, গড়ে ওঠেনি। এই ইনস্টিটিউশনের বিকল্প হচ্ছে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। এখানে রাজনৈতিক দল, তার নেতাকর্মী একটা জটিল ভারসাম্য রক্ষা করে, সমাজকে টিকিয়ে রাখে। এটা যখন নষ্ট হয়ে যায়, তখন প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীগুলো নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং সহিংসতা, দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ে। আপনি সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন করে পুরো পলিটিক্যাল ফেব্রিক ধ্বংস করে দেবেন, কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। জেলা শহরগুলোর আন্ডারওয়ার্ল্ড, ঢাকা শহরের আন্ডারওয়ার্ল্ডও আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না, তার ব্যবসা-বাণিজ্য, ভাগবাঁটোয়ারা-এই জায়গাটা কে নেবে তখন? আপনি তো সব ওলটপালট করে দিয়েছেন। এলোমেলো করে দে মা, লুটেপুটে খাই-একটা কথা আছে না? আপনি এলোমেলো করে দিয়েছেন রাজনৈতিক বন্দোবস্তকে। এ জায়গা তো ফাঁকা থাকবে না। জায়গাটা কে নেবে? পুলিশ নেবে, প্রশাসন নেবে, আরেকটা হাসিনার শাসন তৈরি হবে। পুরো সমাজ, রাষ্ট্র রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। যে দেশে ইনস্টিটিউশন গড়ে ওঠেনি, সেই দেশের রাজনৈতিক বন্দোবস্তই হলো সমাজকে টিকিয়ে রাখার বিকল্প ব্যবস্থা। আর আপনি সেই ব্যবস্থা ভেঙে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন নামের গুগলি মারলে রাষ্ট্র গড়িয়ে পড়বে গ্যাংয়ের হাতে, পুলিশের হাতে, প্রশাসনের হাতে, স্থানীয় মাফিয়ার হাতে।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও