
গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর: দেশ কোন দিকে যাচ্ছে
সেই দৃশ্যটা আমি এখনো ভুলতে পারি না।
আজকাল সামাজিক মাধ্যমে নানা ধরনের ছোট ছোট ভিডিও থাকে। কিছু থাকে নিছক হাসির, কিছু থাকে সামাজিক বক্তব্যনির্ভর। ছেলে-বুড়ো অনেককেই দেখি সেইসব রিলস বা শর্টসে বুঁদ হয়ে থাকতে। আমি নিজেও যখন ক্লান্ত থাকি, অল্প সময়ের জন্য মনটাকে একটু হালকা করতে চাই, এসব দেখি। কিন্তু যত কিছুই দেখি না কেন, ওই যে দৃশ্যটা, দ্রুত পায়ে শেখ হাসিনা আর তাঁর বোন হেঁটে গাড়িতে উঠছেন, পাশেই একটা সামরিক হেলিকপ্টার চালু অবস্থায় মাটিতে দাঁড়িয়ে, কিন্তু দুই বোন গিয়ে কালো জিপটাতেই উঠলেন—জাস্ট ভুলতে পারি না। বিভিন্ন মিডিয়াতে এই ঘটনার যতগুলো ভিডিও দেখেছি, সব একই রকম। একটা গাছের আড়াল থেকে কেউ একজন শক্তিশালী ক্যামেরা দিয়ে ভিডিওটি করেছেন। কে তিনি? এখন পর্যন্ত সেই ব্যক্তির পরিচয়টা আমি কোথাও পাইনি। তিনি সম্ভবত ওই সরকারের ভেতরেরই কেউ হবেন। না হলে প্রটেক্টেড ওই এলাকায় ঢুকবেন কী করে? তবে আমার এটাও মনে হয়, তিনি সে সময় বেশ ভয়ে ছিলেন। তাই গাছের পাতার আড়াল থেকেই ভিডিওটা করেছেন।
ব্যক্তিটি যে-ই হোন না কেন, যেভাবেই দৃশ্যটা ধারণ করুন না কেন, একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তিনি মানুষের মনে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। মানুষ উপলব্ধি করতে পেরেছে—অতি ক্ষমতাবান ব্যক্তি, যাঁর মুখের সামান্য একটা অভিব্যক্তি হাজারো মানুষের বাঁচা-মরার কারণ হতে পারে, তাঁর মধ্যেও মৃত্যুভয় রয়েছে। তিনিও অপরাজেয় নন। ক্ষুব্ধ ও ঐক্যবদ্ধ সাধারণ মানুষ তাঁকে পরাজিত করতে পারে। জনগণ খেপে গেলে স্বৈরাচারী শাসক, তাঁর অনুগত শান্ত্রী-সামন্ত, মারাত্মক মারণাস্ত্র—সবকিছুই শুকনো পাতার মতো উড়ে যায়।
কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করে, আগস্ট ২০২৪-এর আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তিটি কী? আমি বলব—জনগণের মনের ওই সাহসী প্রত্যয়টিই আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন। সাধারণ মানুষ এখন বিশ্বাস করে, কোনো স্বৈরশাসকই অপরাজেয় নয়। মানুষ রুখে দাঁড়ালে লেজ গুটিয়ে তাঁরা নেংটি ইঁদুরের মতো পালিয়ে যান।
প্রাপ্তি কি কেবল এতটুকুই? আর কিছু নেই? আছে, আরও কিছু আছে। তবে সেসব প্রত্যাশার তুলনায় খুবই কম। একটু ডিটেইলে বলি।
হাসিনা ও তাঁর পারিষদবর্গ পালিয়ে যাওয়ার পর মানুষ খুব করে আশা করেছিল—এবার বুঝি একটা ভালো কিছু হবে। অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ, প্রশাসন—সব জায়গাতেই ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠিত হবে। দেশের বাস্তবতায় সেসব যে এত দ্রুত হওয়া সম্ভব নয়, এটা মানুষ বুঝতে চায়নি। তারা ভেবেছে, হাসিনাকে যদি তাড়ানো সম্ভব হয়, তাহলে এসব সুশাসন কেন সম্ভব হবে না?
প্রত্যাশিত সুশাসনের পূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব না হলেও তার প্রক্রিয়াটা কি শুরু করা যাবে না? সুশাসনের পথে দু-একটা পদক্ষেপ কি আমরা দিতে পারব না? এসব প্রশ্নেরও যে খুব আশাব্যঞ্জক জবাব পাওয়া যাচ্ছে, তেমনটি বলা যাবে না।
আসলে ঝামেলাটা কোথায়? আমার বিবেচনায় ঝামেলার শুরুটা হয়েছিল একেবারে শুরুতেই। জনগণের বিপুল সেই প্রত্যাশার বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ভুল মানুষের হাতে। স্বৈরশাসক বিতাড়নে জনগণ যে বিপুল ক্ষোভ ও সাহসের প্রকাশ ঘটিয়েছিল, তার উৎসটা আসলে কোথায় ছিল? সাধারণ মানুষের মনোজগতে। পুঞ্জীভূত ক্ষোভের উত্তাপে তাদের মনে দীর্ঘদিন ধরে ঘুমিয়ে থাকা চেতনা জেগে উঠেছিল। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, ড. ইউনূস সেই চেতনাকে স্পর্শ করার ক্ষমতাই রাখেন না। এই দেশের সাধারণ মানুষকে তিনি চেনেন না। তিনি অন্য জগতের বাসিন্দা। তিনি গ্রামীণ ব্যাংক করেছেন, কিন্তু গ্রামের মানুষের মনটাই বোঝেন না। গ্রামের মানুষের কষ্ট বলতে তিনি সুদ করে মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নেওয়াকে মনে করেন। তিনি গ্রামের মানুষের জন্য তুলনামূলক সহজ শর্তের ঋণ ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। এর বাইরে যে গরিব মানুষের আরও কিছু চাহিদা থাকতে পারে, এটা উপলব্ধির চেষ্টা তিনি করেননি। নিজে ভুক্তভোগী হওয়ার কারণে শেখ হাসিনার প্রতি তাঁর রাগ ছিল—এটা সত্য। কিন্তু সাধারণ মানুষের ক্ষোভ আর তাঁর ক্ষোভ এক নয়। তাঁর ক্ষোভ ছিল—হাসিনা তাঁর বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা করেছে, সেগুলোর কারণে তাঁকে কষ্ট পেতে হচ্ছে, তাঁর সময় নষ্ট হচ্ছে, তিনি তাঁর স্বাভাবিক কাজগুলো করতে পারছেন না। তাই দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রথমেই তিনি নিজের কষ্টগুলোর নিরাময় করে নিয়েছেন। কিন্তু জনগণের মধ্যেকার যে ভোট, ভাত, নিরাপত্তা, সুশাসন ইত্যাদির প্রত্যাশা, সেগুলো বাস্তবায়নে তিনি তেমন কোনো তাড়া অনুভব করেননি।
আমাদের জন্য বেদনার আরেকটা জায়গা হলো—তিনি নিজে যেমন সাধারণ মানুষের দুঃখ, বেদনা, চাহিদা থেকে দূরবর্তী জায়গায় অবস্থান করেন, তিনি যাঁদের নিয়ে কেবিনেট গঠন করেছেন, তাঁদের অধিকাংশই তাঁর কাছাকাছি চরিত্রের। মোদ্দা কথা, এলিট শ্রেণির কতিপয় বয়স্ক ব্যক্তিকে নিয়ে এসে পুরো কেবিনেটকেই একটা প্রবীণ ক্লাবে পরিণত করেছেন। এদের সততা নিয়ে কোনো প্রশ্ন যদি না-ও করি, যোগ্যতা নিয়ে কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাবে। আমি একেবারে শুরু থেকেই এই লোকগুলোর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলাম। পরে দেখা গেল সাংবাদিক নূরুল কবীরকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস নিজেও বিষয়টা স্বীকার করলেন। এই স্বীকারোক্তির মাধ্যমে তিনি নিজে হয়তো মহৎ সাজার চেষ্টা করলেন, কিন্তু উপলব্ধি করতে পারলেন না তাঁর কথায় দেশের মানুষ কতটা উদ্বেগের মধ্যে পড়ে গেছে! মানুষ আতঙ্ক বোধ করছে—দেশ পরিচালনার দায়িত্ব কতিপয় আনাড়ি লোকের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস