
একুশ শতকে নজরুল
নজরুলের কবিতা মনোমুগ্ধকর চিত্রকল্পময় জীবনরেখা। তার কবিতা একদিকে প্রেম, অন্যদিকে দ্রোহ। স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামশীল এই কবির শিল্পবেদ—মানুষের জন্য কবিতা। নজরুল মননশীল, উচ্চকণ্ঠ। বিশ্ব-সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, আধিপত্যবাদ ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী অনন্য কবি প্রতিভা।
বিজ্ঞাপন
সামাজিক বৈষম্য, বিচারহীনতা, সবলের দমন পীড়ন, সাম্প্রদায়িকতা, শোষণ ও নির্যাতনে নির্বাপণের অকুতোভয় যোদ্ধা। তার নিজেরই স্বীকারোক্তি—‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণতূর্য।’
রক্ষণশীল ভারতবর্ষে নারীমুক্তির দিশারী, অগ্রদূত। ব্যষ্টি ও ব্যষ্টিক স্বাধীনতা, মানবমুক্তির পথ নির্মাণ মতপ্রকাশের স্বাধীনতার লড়াই তার রচনা এবং তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তার প্রতিটি কবিতা ও গান ব্যক্তি থেকে সামাজিক, সমাজ থেকে রাষ্ট্র, জন্ম থেকে মৃত্যু পরাজয়হীনতার সুরে দোলায়িত। এজন্য অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্ম তিনি দেখেছিলেন।
‘নমঃ নমঃ নমো
বাঙ্লাদেশ মম
চির-মনোরম
চির মধুর
বুকে নিরবধি
বহে শত নদী
চরণে জলধির
বাজে নূপুর।।’
স্বধর্ম ইসলামের প্রতি তার গভীর ভালোবাসা আবার অন্য ধর্মের প্রতি বিশেষ করে সনাতন বা হিন্দু ধর্মের প্রতিও তিনি সশ্রদ্ধ। তিনি বলতেন—‘ভারতবর্ষে প্রেম হলো বন্দি আমি তাকে মুক্ত করতে চাই।’
নজরুল প্রকৃত প্রস্তাবে একজন বিপ্লবী কবি। তিনি রাষ্ট্রশক্তির মৌলিক পরিবর্তন চেয়েছিলেন। কারণ তিনি জানতেন সরকার পরিবর্তিত হলেই বিপ্লব ঘটে না। বিপ্লব ঘটে একাল আদর্শিক জায়গা থেকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আশ্রয়, খাদ্য, চিকিৎসা মৌলিক চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণ। এগুলো প্রাথমিক শর্ত।
বৃহত্তর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি। অরিয়েন্ট লংম্যান কর্তৃক প্রকাশিত বিনয় ঘোষের বাংলার নবজাগৃতির নবম সংস্করণ (১৯৭৯)-এ তিনি বুমফিল্ড শীল প্রমুখের বক্তব্যের সঙ্গে সাহায্যপূর্ণ মন্তব্য করেন—The upper caste Hindus who become Bhadralok and ‘Babus’; by their caste and status. And English education where completely enslaved and logically made liseerior through and through and through এবং বাংলায় জাগরণ সম্পর্কে তার মন্তব্য—What we all Bengal renaissance turned out to be nothing but the historical hoax।
অধ্যাপক বরুণ দে বলছেন, বাঙলার জাগরণের যারা নায়ক তাদের ‘Comprador intelligentsia’ নামে অভিহিত করা সঙ্গত। এদের ভূমিকা সম্পর্কে তিনি আরও বলেন—‘Middle-class subalterns’।
নজরুল ছিলেন প্রকৃতপ্রস্তাবে রেনেসাঁর শেষ সন্তান, বুদ্ধিজীবী। নজরুল সম্পর্কে মার্কিন বুদ্ধিজীবী ও লেখক ইউলস্টন ল্যাংলি বলেন—নজরুল হচ্ছে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সবিশেষ উপনিবেশবাদ বিরোধী কবি ও বুদ্ধিজীবী। রেনেসাঁর মূল লক্ষ্য মানবতার মুক্তি যা উনিশ শতকের বুদ্ধিবৃত্তিকতার কেন্দ্র; বিশ শতকেও রেনেসাঁর আবশ্যকতা ছিল আজ একুশ শতকেও আছে। যেখানে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায়, মতপ্রকাশেরর স্বাধীনতার আন্দোলন থাকবে।
আমরা কবি কাজী নজরুল ইসলামের চিন্তা ও চেতনায় প্রকাশ দেখি। নজরুল ছিলেন রেনেসাঁর প্রায়োগিক সন্তান। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ রেনেসাঁর স্রোতকে প্রবহমান রেখেছিলেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত কবিদের মধ্যে এই রেনেসাঁর নির্ভীক সন্তান। নজরুল তার উত্তরাধিকার বহন করেছিলেন।
নজরুলের গান, কবিতা হিন্দু-মুসলিম উভয়েরই। তিনি মুসলমানের জন্য লিখছেন, ইসলামী গান, হামদ-নাত আর হিন্দুদের জন্য শ্যামা সংগীত। তিনি লিখেছেন গজল, আধুনিক গান আর কীর্তন। নজরুলের শ্রেষ্ঠত্ব তার কাব্যের নতুনত্ব নিয়ে। ইংরেজি সাহিত্যে যেমন উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের পর যেমন এসেছিলেন জন মিলটনের paradise regained। নিঃসন্দেহে তা ঐশ্বর্য, বর্ণ বিন্যাস, রচনা কৌশল ও নান্দনিকতায় তুলনাহীন। ডব্লিউবি ইয়েটস, টি এস এলিয়ট, এজরা পাউন্ড আধুনিক যুগের দ্রষ্টা।