অলংকার - একটি প্রাচীনতম শিল্পের নাম। প্রথম কবে, কোথায়, কেন অলংকারের ব্যবহার শুরু হয়েছিল তা জানা না গেলেও সুদূর প্রস্তরযুগেও যে অলংকারের ব্যবহার ছিল, তার বেশ কিছু নিদর্শন পাওয়া।
বর্তমানে অলংকারকে নারী ভূষণ হিসেবে ধরা হলেও অতীতে নারী-পুরুষ উভয়েই অলংকার ব্যবহার করত। বরং পুরুষরাই অলংকার পরতো বেশি! পুরুষদের অলংকারের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল নিজেকে মেয়েদের কাছে আকর্ষণীয় করা। বিশেষ করে অবিবাহিত পুরুষরা বিয়ের উদ্দেশ্যে নারীকে আকর্ষণ করতে চাইতো অলংকার পরিধান করে!
বর্তমান সময়ে আমরা যে অলংকারগুলো ব্যবহার করি সেগুলো দীর্ঘ বিবর্তনের ফল। হাজার হাজার বছর ধরে অন্যান্য বিষয়ের মতো অলংকারের উপাদান ও নকশায় এসেছে নানা পরিবর্তন। কারা, কখন, কীভাবে অলংকার ব্যবহার করেছে, কোন সমাজের অলংকার কেমন, অতীত-বর্তমানের পার্থক্য - এসব দৃষ্টিকোণ থেকে অলংকারের পরিবর্তনের ধারা বিবেচনা করা হয়।
পৃথিবীর প্রতিটি দেশের বা সমাজের রয়েছে আলাদা আলাদা বৈশিষ্টপূর্ণ অলংকার। এসব অলংকারকে বলা হয় ফোক জুয়েলারি বা লোক অলংকার। অভিধান অনুযায়ী লোক বা ফোক (Folk) বলতে লোক, জনসাধারণ এবং বিশেষ শ্রেণীর লোক বা জনসাধারণকে বোঝায়। এজন্য ইংরেজি Folkdance কে লোকনৃত্য, Folksong কে লোকসংগীত, Folkart কে লোকশিল্প বলা হয়। অর্থাত্ এই বিষয়গুলোর সাথে যে সমাজের বিশেষ কোনো শ্রেণীর মানুষের সম্পর্ক রয়েছে, তা সহজেই বোঝা যায়। এই 'বিশেষ শ্রেণী' বলতে মূলত গ্রামের সাধারণ মানুষদের বোঝায়। লোকশিল্প যেমন গ্রামীণ মানুষের তৈরি শিল্প, তেমনি লোক অলংকারও গ্রামের সাধারণ শ্রেণী মানুষের তৈরি ও ব্যবহৃত অলংকার।

বাংলাদেশের সংস্কৃতিতেও রয়েছে লোক অলংকারের উপস্থিতি। বাংলাদেশ আকারে ছোট বলে এখানে লোক অলংকারে খুব বেশি বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায় না। কারণ এখানে বিচিত্র ধর্ম ও বর্ণের মানুষের উপস্থিতি খুব কম। তাই প্রায় সব জায়গাতেই একই ধরনের লোক অলংকারের প্রচলন দেখা যায়। চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল, ময়মনসিংহ, সিলেট এবং রাজশাহীর কিছু কিছু অঞ্চলে আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাস রয়েছে। সামাজিক রীতিনীতি ও ধর্ম-বর্ণের বিভিন্নতার কারণে তাদের ব্যবহৃত অলংকারে কিছু পার্থক্য রয়েছে।
আসুন, জেনে নিই বাংলাদেশে প্রচলিত কিছু লোক অলংকার সম্পর্কে -
ধানতাবিজের মালা :
ধানতাবিজ দেখতে অনেকটা ধানের মতো বলেই এর নাম ধানতাবিজ! ধানের মতো দুই মাথা তীক্ষ্ম ও পেট মোটা করে এই তাবিজ তৈরি করা হয়। তাবিজের ভেতরের অংশটা ফাঁপা থাকে। তাবিজের মোটা অংশের ঠিক মাঝখানে মালা গাঁথার সুবিধার জন্য ছোট একটি আংটা থাকে। এই আংটার ভেতর দিয়ে লাল বা কালো রঙের মোটা সুতা প্রবেশ করিয়ে ধানতাবিজের মালা গাঁথা হয়। মালায় কতগুলো তাবিজ থাকবে তার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, এটা নির্ভর করে ব্যবহারকারীর মর্জির ওপর। এই তাবিজ অতি সাধারণ একটি অলংকার হলেও কখনো কখনো সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য এতে পুঁতিও ব্যবহার করা হয়। ধানতাবিজের মালার ব্যবহার এখন তেমন নেই বললেই চলে। গ্রামে কদাচিত্ কোনো মেয়ের গলায় ধানতাবিজ দেখতে পাওয়া যায়। তবে ইদানীং বিভিন্ন দেশীয় উত্সবে, যেমন, পহেলা ফাল্গুন, পহেলা বৈশাখে শহুরে মেয়েদের ধানতাবিজের মালা পরতে দেখা যায়। গ্রামীণ নাচের অলংকার হিসেবেও ধানতাবিজ ব্যবহৃত হয়।
মাদুলি :
মাদুলি সাধারণত দোয়া বা কবিরাজি ওষুধ অথবা শিকড়-বাকড় রাখার জন্য ব্যবহৃত হলেও এটাকেও লোক অলংকার হিসেবে গণ্য করা হয়। লোকসমাজে মাদুলি তাবিজ নামেই পরিচিত। মাদুলি নানা আকৃতির হয়ে থাকে। সাধারণত ছোটগুলো সিলিণ্ডার আকৃতির আর বড়গুলো চ্যাপ্টা বাক্সের মতো করে তৈরি করা হয়। এগুলোর একদিকের মুখ খোলা থাকে। মাদুলিতে প্রয়োজনীয় জিনিস প্রবেশ করানোর পর এর খোলা মুখ মোম বা গালা দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়। লাল বা কালো সুতা দিয়ে মাদুলি গলায় এবং বাহুতে পরা হয়।
মুদ্রার অলংকার :
মুদ্রা বা ধাতুর তৈরি গোলাকৃতির টাকা অথবা পয়সার সমন্বয়ে এক ধরনের নেকলেস তৈরি করে গ্রামের সাধারণ মেয়েরা পরে থাকে। আংটা লাগানো মুদ্রা সুতা বা চেইনে গেঁথে এই নেকলেস বানানো হয়। বর্তমানে আধুনিক অলংকারেও এই ডিজাইনের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
নথ :
নাকের অলংকারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নথ। বলয়াকৃতির এই অলংকার ঠোঁটের উপরে নাকের অংশে ফুটো করে পরা হয়। নথ ছাড়াও বালি বা রিং এবং নাকফুলও লোক অলংকারের অন্তর্ভুক্ত।
মাকড়ি :
গ্রাম্য মেয়েদের অতি সাধারণ একটি কানের অলংকার হলো মাকড়ি। মাকড়ি নানা আকৃতির হয়ে থাকলেও অর্ধ চন্দ্রাকৃতির মাকড়ি বেশি জনপ্রিয়। মাকড়ির মতো দেখতে কানের দুল শহর অঞ্চলেও বেশ জনপ্রিয়। তবে এগুলো একটু জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে তৈরি করা হয়।
মল ও খাড়ু :
মল এবং খাড়ু দুটোই পায়ের অলংকার। বর্তমানে এগুলোর প্রচলন নেই বললেই চলে! তার বদলে ঠাঁই নিয়েছে নুপূর বা পায়েল।
চুলের কাঁটা :
চুলের কাঁটা গ্রামের মেয়েদের কাছে খুব প্রিয় একটি অলংকার। খোঁপাকে সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে সাজানোর ক্ষেত্রে কাঁটার জুড়ি নেই! চুলের কাঁটা বেশ কয়েক ধরনের হয়ে থাকে, তবে পিনের মতো সোজা ও ইউয়ের মতো বাঁকানো চুলের কাঁটা বেশি জনপ্রিয়।
হাঁসুলি :
হাঁসুলি হলো এমন একটি গলার অলংকার যা গলাকে বেষ্টন করে থাকে। হাঁসুলি মূলত লোক অলংকার হলেও আধুনিক অলংকারেও এই ডিজাইনের সমান উপস্থিতি রয়েছে।
বিছা :
কোমরের বিছা কমবয়সী মেয়েরাই বেশি পছন্দ করে। সামাজিক উত্সবগুলোতে বিছা পরা হয় বেশি। বিছাকে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয় লোক অলংকারে।
বালা ও চুড়ি :
বালা বা চুড়ি নারীদের হাতের অলংকার হিসেবে বাংলাদেশের লোক অলংকারে স্থান পেলেও এগুলো মূলত পার্সিয়ান পুরুষদের হাতের ব্রেসলেট থেকে এসেছে। অতীতে বাংলাদেশে আদিবাসী নারীরা হাত ভর্তি কড়া (বালার মতো দেখতে) পরত। লোক অলংকারে চুড়ি বা বালা বিবাহিত নারীদের অলংকার হিসেবে বিবেচিত হয়।
আদিবাসী অলংকার :
ফোক বা লোক অলংকারের মধ্যে আদিবাসীদের ব্যবহৃত অলংকারকেও গণ্য করা হয়। আদিবাসী নারীরা তুলনামূলক বেশি অলংকার ব্যবহার করে থাকেন। বাংলাদেশের চাকমা মেয়েরা মুদ্রার তৈরি নেকলেস, পুঁতি ও মুক্তার মালা, প্রবালের চুড়ি এবং আংটি পরেন। সাঁওতাল মেয়েরা বাংলাদেশের সাধারণ রমণীদের মতোই অলংকার পরেন। গারো মেয়েরা অনেকগুলো পুঁতির মালা একসঙ্গে পরেন। মগ রমণীদের বিশেষত্ব হলো পায়ের অলংকারে। তারা অনুষ্ঠানে অন্যান্য অলংকারের পাশাপাশি পা ভর্তি অলংকার পরে।
কোনো জাতির পরিচয় পাওয়া যায় তার সংস্কৃতি ও শিল্পে। লোক অলংকার আমাদের শৈল্পিক জীবন ও সংস্কৃতিকেই বহন করে। মূলত, লোক অলংকারের বৈচিত্র্যময় রূপের অনুকরণেই আধুনিক অলংকারের নিমার্ণ হয়।