
ছবি সংগৃহীত
দেশীয় ঐতিহ্যে হাতপাখা
আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৩, ০৮:৪৭
বাংলায় নতুন বছরের সাথে সাথে শুরু হলো গ্রীষ্মকাল। গরমটা এখন এবার বেশ জোরেশোরে পরারই প্রস্তুতি নিচ্ছে। দুঃসহ এই গরমে মানুষ এখন একটু বাতাসের আশায় অস্থির হয়ে থাকবে। তপ্ত রোদে চলা পান্থ বা পথিক খুঁজবে একটু বাতাসের স্পর্শ। কিন্তু গরমের সাথে সাথে বাড়ে লোডশেডিং। নগরজীবনে তাই আর দুর্ভোগের শেষ থাকেনা তখন। বিদ্যুৎ-বিভ্রাট কবলিত প্রযুক্তিনির্ভর যুগেও গরমের দুর্ভোগ থেকে স্বস্তির জন্য আদি ও অকৃত্রিম হাতপাখার ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে এখনো। শীতাতপ-নিয়ন্ত্রণযন্ত্র ও যান্ত্রিক পাখার প্রতাপের কালেও কদর কমেনি হাতপাখার। তাই তো আজকাল অভিজাত বুটিক বাড়ি কিংবা ফ্যাশনহাউজগুলোও নজর দিচ্ছে বাহারি হাত পাখার উপর। এসব হাতের পাখা নানা ঢং আর রঙ-এ চলে আসছে অভিজাত ড্রইং রুমের সৌন্দর্য বৃদ্ধির উপকরণ হয়ে। তাই আজ আর হাত পাখা শুধু হাওয়া খাওয়ার জন্য নয়, আরও বেশি কিছুতে পরিণত হয়েছে। পাখার নকশা হাওয়া খাওয়া ছাড়াও লোকে ঘর সাজানো বা বিয়ের গায়ে-হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য বিভিন্ন সুদৃশ্য পাখা কেনেন। পদ্ম, শতফুল, ঊনিশকাঁটা, সংকলন, বরফি, শিঙারা, শঙ্খ, আয়নাকোটা, শঙ্খপদ্ম, ঝুরিফুল, চালতা ফুল, পানপাতা, তারাফুল, চারমাছ, হাতিবান্ধা, মোরগ, চৌখুপি, চক্র—এসব হলো পাখার নকশার নাম। এমন আরও অনেক নকশা আছে। কোনো কোনো নকশার মধ্যে আয়নার টুকরোও বসানো হয়। পাখা তৈরী চিকন বুননের নকশায় একটি বড় পাখা করতে পুরো এক দিন লেগে যায়। ২৭০ টাকা পাউন্ডের উন্নত চীনা সুতোয় পাখা বোনা হয়। একটি পাখা তিন-চার বছর পর্যন্ত চলে যায়। প্রথমে বাঁশের কাঠি দিয়ে বৃত্ত তৈরি করে নিতে হয়। এর নাম মূলট। এর ওপরেই সুতোর বুনন। সরু চোঙের মধ্য দিয়ে হাতলের সঙ্গে মূলট জুড়ে তার চারপাশে লাল কাপড়ের ঝালর দিয়ে হাতলের ওপরের মাথায় রঙিন সুতোর মোড়ন দিলেই পাখা তৈরি সম্পন্ন হয়। এ তো গেল সুতোর তৈরি বাহারি পাখার কথা। হাত পাখার ক্ষেত্রে তালের পাখার ব্যবহার বরাবরই এগিয়ে। সচরাচর যে তালপাতার পাখা হাতে হাতে ঘুরে বা দুলে দুলে গরম তাড়ায়, তারও বেশ রকমফের আছে। পাটির মতো বুনন বা বাঁশের দুই কাঠির মাঝখানে সুতোয় গাঁথা ভাঁজ করে রাখার পাখা প্রভৃতি।v তালের পাতায় নানা রঙের ডিজাইন করা পাখাও পাওয়া যায়। তাছাড়া গ্রামের অনেক মেয়েরাই পাটি পাখা, কাপড়ের নকশা করা পাখা, সুতায় বোনা পাখাসহ নানা রকম পাখা তৈরি করে। ব্যবসায়িক ভিত্তিতে এসব পাখা তৈরি হয়ে থাকে। প্রাচীনকালেও এ উপকরণে হাত পাখা তৈরি হতো। তবে আজকাল রকমফেরের আধিক্য দেখা যায়। যে সব এলাকায় পাখা তৈরী হয় পাখা তৈরির জন্য কিশোরগঞ্জ, কৈতরকান্দি, নারায়ণগঞ্জ, সোনারগাঁ, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল করটিয়া, খুলনা, বাগেরহাট, যশোর বরিশাল প্রসিদ্ধ। তাছাড়া, নওগাঁ, নোয়াখালি ও ঢাকার কিছু কিছু অঞ্চলে পাখা তৈরী হয়। তালপাখা নওগাঁ, ঢাকা, নোয়াখালীর হাতপাখা বিখ্যাত। তাল গাছের বেশ বড় পাতাসহ কেটে বিভিন্নভাবে প্রক্রিয়াকরণ করে তাল পাখা তৈরি করা হয়। সাদামাটা এই পাখাগুলো সর্বত্রই পাওয়া যায়। ১৫ টাকা থেকে শুরু করে স্থান ভেদে ২৫ টাকা পর্যন্ত তাল পাখার দাম হতে পারে। গরমে বড় তালপাখার সাথে ছোট ছোট তাল পাখার চাহিদা বেশি। স্কুল-কলেজের সামনে অপেক্ষমান অভিভাবকগণ প্রচন্ড গরমে স্বস্তি পেতে হাতে তুলে নেন ছোট পাখা। এগুলোর দামও কম। সাধারণত গাজীপুর অঞ্চল থেকে এই পাখাগুলো আনা হয়। বিভিন্ন রকম পাখা তালপাখার পাশাপাশি কাপড়ের পাখার ঐতিহ্যও প্রাচীন। গ্রাম বাংলার ভিন্ন মেলার গন্ডি পেরিয়ে আজ নগর জীবনের মেলাগুলোতেও বিভিন্ন রকম কাপড়ের পাখা দেখতে পাওয়া যায়। খুলনা, বাগেরহাট, সিলেট ও বরিশাল অঞ্চলে কাপড়ের নকশি পাখাগুলো পাওয়া যায়। চৈত্র মাসের আগেই এসব এলাকার মেয়েরা পাখা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পুরনো কাপড়ে রঙ দিয়ে তাতে নানা রঙের সুতার কাজ করে পাখা তৈরি হয়। অনেক পাখায় ঝালরও লাগানো হয়। পাখার ডাটিতে আছে বৈচিত্র্য। অনেক পাখায় বাঁশের একটা চোঙ দেয়া থাকে। এতে পাখাটি ঘোরাতে সুবিধা হয়। এ সকল বাহারি পাখা ঘর সাজানো ও উপহার দেবার উপকরণ হিসেবেও ব্যবহার হয়। যশোর ও নারায়ণগঞ্জ-এ সুতোয় বোনা পাখা পাওয়া যায়। নানা রকম ও রঙের সুতা ব্যবহার করে এই পাখাগুলো তৈরি হয়। মেলা পার্বণে এই পাখার কদর বেশি। আড়ং সহ অনেক ফ্যাশন হাউজে এই পাখা পাওয়া যায়। সুতোয় বোনা পাখার দাম একটু বেশি। তবে ৩০০ টাকার ভিতর একটি পাখা পাওয়া যাবে। এসব পাখা ছাড়া আছে শোলা ও বেতের পাখা, পাটির পাখা প্রভৃতি। আজকাল কাগজ ও প্লাস্টিকের হাত পাখারও একটা বাজার চাহিদা আছে। পাখার নাম পাখা যে শুধু দেখতে বাহারি তা কিন্তু নয়, পাখার রয়েছে নামেরও নানান বাহার। অঞ্চল ভেদে কিছু পাখাকে ভালবাসা, শঙ্খলতা, মানবিলাসী, বাঘাবন্দী, হাতফুল মানবাহার, পালং পোষ, কাঞ্চন মালা, মন সুন্দরী লেখা ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। মূলত নকশার ভিত্তিতেই এ রকম নাম দেয়া হয়। অনেক পাখার গায়ে নানা রকম ছন্দ,কবিতাও স্থান পায়। আগুনঝরা এই খরতাপে একটু শীতল বাতাস পেতে হাতপাখা এখন মানুষের হাতে হাতে। বিদ্যুতের লোডশেডিং অব্যাহত থাকায় ডায়রিয়াসহ গরম জনিত রোগ ও হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। তীব্র তাপদাহ ও বিদ্যুতের অব্যাহত লোডশেডিংয়ের ফলে হাত পাখার চাহিদাও বেড়ে চলেছে সমান গতিতে। এখন মানুষের একটি প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ হচ্ছে এই হাতপাখা। ছবি- ফ্লিকার ডট কম