ছবি: লয়েড তুহিন হালদার
শুধু পুরুষ নন, রাজধানীর রাস্তায় এখন নারী বাইক রাইডারদেরও চোখে পড়ে। শহরের এই সাহসী মুখগুলোে এগিয়ে যাচ্ছেন নানা সঙ্কটের ভেতর দিয়ে। প্রিয়.কম এবার হাজির করলো সাহসী ওমেন বাইক রাইডারদের। তাদের নিয়ে লিখেছেন মাহমুদ উল্লাহ।
(প্রিয়.কম) ‘আমি পেন্সিল হিল পড়ে বাইক চালাই’ মাথা থেকে হেলমেট খুলে
চুলগুলো দুদিকে ঝাড়া দিয়ে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন বাংলাদেশ ওমেন বাইক রাইডার ক্লাবের নবীন সদস্য জান্নাতুল।
ঢাকার রাস্তায় তাকালেই এখন চোখে পড়ে, নারীরা সাইকেল বা মটরবাইক চালাচ্ছেন। এই সংখ্যা খুব বেশী নয়। ঢাকার মানুষ এতো বেশি সামাজিক যে সাইকেল চালানোকে সম্মানহানীকর মনে করে। প্রয়োজনে সে বাসে বাদুড় ঝোলা হয়ে চলাচল করবে।অথচ বিদেশে সাইকেলকে খুব জরুরী বাহন হিসেবেই দেখা হয়।ঢাকায় এখন মটরসাইকেল অনেক বেড়ে গেছে।তবে নারী বাইক রাইডার খুব একটা চোখে পড়ে না।
তবে সেই ট্রেন্ড এখন ভেঙে যাচ্ছে।ঢাকা শহরের মেয়েরা বেশ কয়েক বছর ধরেই বেশকিছু সাইকেল গ্রুপের সঙ্গে একাত্ম হয়ে সাইকেল চালায়।এখন রাস্তায় বের হলে দু’একটা মটরসাইকেলরোহী নারীও চোখে পড়ে। হ্যাঁ, নারী বাইক রাইডারদের কথা বলছি। ঢাকায় এখন প্রায় দেড়শো’র মতো নারী মটরসাইকেলরোহী আছে। এদের মধ্যে একজন হলেন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার ইশরাত খান মজলিস। তিনি শহুরে নারী বাইকারদেরকে নিয়ে একটি সংগঠন করেছেন, নাম দিয়েছেন ‘বাংলাদেশ ওমেন রাইডারস ক্লাব’।
ইশরাত প্রথমে আরেক সদস্য আর্কিটেক্ট তাসমিনা খান ও মাহিনুর আক্তার নীপাকে নিয়ে শুরু করেন গ্রুপটি। এখন এর সদস্য সংখ্যা ৫০ এর উপর। গ্রুপের বেশিরভাগই চাকরিজীবি।রাস্তায় চলাফেরা করতে তাদের নানা অভিজ্ঞতা ও অন্যান্য বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এই গ্রুপের সদস্যদের সঙ্গে কথা হয় প্রিয়.কমের। নিচে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো:

প্রিয়: বাংলাদেশ ওমেন বাইক রাইডার গ্রুপের শুরু হয় কিভাবে?
ইসরাত: রাস্তায় বের হলে বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হয়, একটি গ্রুপ থাকলে তা ফেস করতে অনেক সুবিধা, এছাড়া বাইকের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান ও সব নারী রাইডারদের একত্রিত করার একটি ইচ্ছা থেকেই মূলত আজকের এই গ্রুপ। প্রায় বছর দেড়েক আগে আমরা এটা শুরু করি। এরপর রাস্তায় বিভিন্ন মেয়েদের বাইক চালাতে দেখলে যেচে পড়ে গ্রুপ মেম্বার হতে উদ্বুদ্ধ করি।
প্রিয়: এই গ্রুপের কর্মকান্ডগুলো বলেন?
ইসরাত: আমরা বিভিন্ন সময় বাইক নিয়ে আউটিং এ বের হই, এইতো কিছুদিন আগে ধলেশ্বরী নদীর পাড় থেকে ঘুরে আসলাম। বাসা থেকে সবাই রান্না করে নিয়ে গিয়েছিলাম। সবাই খুব মজা করি। আর ঢাকায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় রাইড দেই। আরা সামাজিক কর্মকান্ডগুলো তো আছেই। ওমেন অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে আমরা সবাই বিভিন্ন গ্রুপের হয়ে কাজ করি। ওমেন এন্ড চাইল্ড ভায়োল্যান্সের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ক্যাম্পেইন করি। এর আগে একটা সেলফি কন্টেস্টও করেছি। আমরা এই বছর খানেকের মধ্যে প্রায় ১০টার মতো অ্যাক্টিভিস্ট এক্টিভিটি করেছি। রিসেন্ট আমেরিকান ওমেন বাইক রাইডারদের গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হযেছি।
প্রিয়: রাস্তায় বাইক চালাতে কোন ধরনের ঈভটিজিংয়ের স্বীকার হতে হয় কিনা?
ফাতেমাতুজ্জোহরা: রাস্তায় ছেলেরা বিভিন্ন টোন করে, মটরবাইক নিয়ে রেস দিতে উদ্বুদ্ধ করতে চায়, তখন মনে হয় তাদের কাছে মেয়েদের বাইক চালানো হাস্যকর একটা ব্যাপার।
প্রিয়: কখনো কোন অপ্রীতিকর ঘটনার মুখে পড়তে হয়েছে কিনা?
হুসনেয়ারা বন্যা: একবার এক ছেলের পায়ের কাছে বাধ্য হয়ে ব্রেক করতে হয়, সে বলে তার জুতায় নাকি চাকা লেগেছে।কিন্তু আসলে কোনভাবেই লাগেনি, ছেলেটিকে এডিক্টেড মনে হচ্ছিলো।তার হাতে একটি হাতুড়িও ছিল, যা দেখে আমি ভয় পাচ্ছিলাম।পরে আশেপাশের লোকজন আমাকে চলে যেতে বললে চলে যাই।
ইসরাত: রাস্তায় অন্যান্য মেয়েরা আমাদের দিকে তাকিয়ে যখন হাসি দেয়, তখন খুব ভাল লাগে। মনে হয় কোন ভুল করিনি। কোন ছেলে যখন রেস দিতে চায়, তখন আমি কিছু মনে করি না, কিন্তু ইগোতে লেগে গেলে আমিও রেস দেই।
প্রিয়: বাইক চালানোর জন্য পারিবারিক কোন চাপ বা সমস্যায় পড়তে হয়েছে কিনা?
ইসরাত: আতিকা রুমা আপুরা হচ্ছেন একদম সিনিয়র বাইক রাইডার। তারা যখন বাইক চালাতেন, শুনেছি মানুষ ঢিলও মারতো।
ফাতেমাতুজ্জোহরা: আমি ব্যক্তিগতভাবে বাবা মা থেকে কোন সাপোর্ট পাইনি, আমার আম্মু প্রথমে বলতো, কই আমিতো কোনদিন বাইক চালাইনি, আমার কি জীবন যাচ্ছে না? আমি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। আমার ঝোঁক চেপে গিয়েছিলো যে আমাকে এটা শিখতেই হবে।তারপর আমি শিখি ও চালাই।
প্রিয়: আপনারা কি ফ্যাশনের জন্য বাইক চালান, না প্রয়োজনে চালান?
জান্নাত: অবশ্যই প্রযোজনে।এই সময়ে বাসে উঠা অনেক কষ্টের কাজ।আবার সাইকেল চালানোও ডিফিকাল্ট, সিএনজি ভাড়া অনেক, আবার গাড়িও এফোর্ট করা সহজ নয়। তাই মটরবাইক ছাড়া আসলে এখন ভাবাই যায় না। কিন্তু একই সঙ্গে এটা আবার ফ্যাশনও। এছাড়া মটরবাইক চালালে ছেলেরা একটু সম্মানের চোখেও দেখে।বাস থেকে নামলে নয়, বাইক থেকে নামলেই নিজেকে ফ্যাশনেবল মনে হয়।তাই বাইক প্রয়োজন আবার ফ্যাশনও। এই যে দেখেন আমি পেন্সিল হিল পড়ে বাইক চালাচ্ছি। অনেকে মনে করেন বাইক চালালে কেডস পড়া উচিৎ, আমি তা মনে করি না।
প্রিয়: আপনাদের মধ্যেতো অনেকে বিয়ে করেননি, তো বাইক চালানোর কারণে বিয়েতে কোন সমস্যা হতে পারে কিনা? আর চেহারা কালো হয়ে যাওয়ার ভয় আছে কিনা।
জান্নাত: আমি তো এখন দুধ দিয়ে চেহারা মাস্ক করে ধুয়ে এলাম। ত্বকের প্রতি যত্বতো নিতেই হবে। তাছাড়া হাতে গ্লাভস পড়ে নেই। মাথায় হেলমেট থাকে, খুব একটা সমস্যা হয় না।একটু ফ্যাশন সচেতন থাকলেই চলে।আর বিয়ের ক্ষেত্রেও খুব একটা সমস্যা হবে বলে মনে করি না।
প্রিয়: বাইক চালানো শিখলেন কিভাবে?
জান্নাত: ইউটিউবে ম্যানুয়াল দেখে।
ফাতেমাতুজ্জোহরা: আমার বড় ভাই আমাকে শেখায়, দুজন শিখতে শিখতে রাতে রাস্তার পাশের ঝোপে পড়ে যাই, আশেপাশের লোকজন ভেবেছিলো আমরা চুরি করে পালাচ্ছি। তখন সবাই চলে আসছিলো।
প্রিয়: রাস্তায় মটর বাইক নষ্ট হলে কি করেন?
ইসরাত: আর সবার মতো ঠেলে ঠেলে গ্যারেজে নিয়ে যাই।
প্রিয়: নতুনদের বাইক চালাতে হলে কি প্রয়োজন?
খুকুমনি: একটি বাইক কিনে প্যাকটিস শুরু করে দেয়া উচিৎ। তাই প্রয়োজন বাইক আর সাহস।
প্রিয়: ঢাকায় এতো দেরিতে নারীরা বাইক চালাতে কেন আসলো বলে আপনারা মনে করেন?
ইসরাত: আসলে নিজেকে সেরা জায়গাটায় দেখতে চাইতে হবে। মেন্টালিটি পরিবর্তন করতে হবে। মনের ইচ্ছাটাই প্রধান।এখন সেগুলোর পরিবর্তন হচ্ছে বলেই সম্ভব হচ্ছে।
খুকুমনি: আবার অনেকে সাহস করে বাইক প্র্যাকটিস করে কিছু উষ্টা খেয়ে ছেড়ে দেয়, এজন্যই নারী বাইকার এত কম।