
হিসাব-নিকাশে ভুল করেছেন ট্রাম্প
অকস্মাৎ ইরানে হামলার কারণে ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ যেমন শুরু হয়েছিল, তেমনি আকস্মিকভাবেই সেই যুদ্ধ শেষ হয়েছে। যুদ্ধশেষে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে হিসাব-নিকাশ চলছে, এ যুদ্ধে কার লাভ, আর কার ক্ষতি হলো। যুদ্ধ তো শেষ হলো, কিন্তু তারপর কী? এ ধরনের নানা হিসাব-নিকাশ। এর মধ্যে একজন সাংবাদিক আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আচ্ছা, এই যুদ্ধে তো ইরানের কোনো বিমানকে উড়তে দেখলাম না। ইরানের কি কোনো যুদ্ধবিমান নাই?’ যিনি প্রশ্ন করেছেন, তার প্রশ্নটি সহজ এবং সরল। এর মধ্যে বোকামির কিছু নেই। কারণ ১০ দিনের এ যুদ্ধে ইরানের কোনো বিমান আকাশে ওড়েনি। কিন্তু ইসরাইলের দেখা গেছে, প্রথম এবং দ্বিতীয় দিন যথাক্রমে ২০০ এবং ১০০টি বিমান এ হামলায় অংশ নিয়েছে। এখন ওপরে উল্লিখিত জল্পনা-কল্পনা এবং ওই প্রশ্নটির জবাব দেব।
প্রথমে খুব স্পষ্ট করে বলতে চাই, এ যুদ্ধে লাভ-ক্ষতির হিসাব-নিকাশ করতে যাওয়ার কোনোই অবকাশ নেই। কারণ যুদ্ধটি যদি ইসরাইল এবং ইরানের মধ্যে হতো, তাহলে লাভ-ক্ষতি বা জয়-পরাজয়ের প্রশ্ন উঠত। কিন্তু এ যুদ্ধে জড়িত ছিল আমেরিকা। প্রথম দিন থেকে এবং শেষ অবধি পর্যন্ত। প্রথম থেকে আমেরিকা এ যুদ্ধের পেছনে ছিল। ইসরাইলকে সামনে ঠেলে দিয়ে তারা যুদ্ধ শুরু করেছিল। যখন দেখল, ইসরাইল তার অত্যাধুনিক ওয়্যার মেশিন নিয়েও যুদ্ধে ইরানের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছে না, তখন আমেরিকা ইসরাইলের ওই মুখোশ ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে নিজেই যুদ্ধে নেমে পড়ে। তাদের দুর্ধর্ষ এবং ভয়াবহ বোমারু বিমান বি-২ ইরানের ৩টি পারমাণবিক স্থাপনায় ২০/২১টি মারাত্মক বোমা ফেলে। এর মধ্যে রয়েছে ফোর্দে ভয়ংকর বাঙ্কার ব্লাস্টার বোমা। আমেরিকা ধারণা করেছিল, ইরানের পারমাণবিক বোমা অথবা বোমা তৈরির উপকরণ ওই ফোর্দের পাহাড়ের নিচে পাথরের গর্তের মধ্যে লুকানো আছে। বাঙ্কার ব্লাস্টার বোমা মাটির ৩২ ফিট নিচে পর্যন্ত প্রবেশ করতে পারে। ফোর্দো, নাতাঞ্জ এবং ইসফাহানে বোমা ফেলে ইরানের পারমাণবিক বোমা ধ্বংস করা গেছে কিনা অথবা সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম সমূলে ধ্বংস করা গেছে কিনা, সেটি পরিষ্কার নয়। যদিও বোমা মারার ২ ঘণ্টা পর টেলিভিশন ভাষণে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, ইরানের সব পারমাণবিক সক্ষমতা সম্পূর্ণ মুছে ফেলা হয়েছে (Obliterated)। কিন্তু বাস্তবে সেখান থেকে রেডিয়েশন বা তেজস্ক্রিয়তার কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। পক্ষান্তরে, অন্য সূত্র থেকে বলা হয়েছে, ইরান অনেক আগে থেকেই আশঙ্কা করেছিল, আমেরিকা তার পারমাণবিক স্থাপনাতে বোমা মারবেই। তাই তারা আগে ভাগেই পারমাণবিক বোমা (যদি বানিয়ে থাকে) অথবা তার উপকরণ সরিয়ে ফেলেছে।
ইরানে বিমান আক্রমণ নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গোটা বিশ্বের সঙ্গে মোনাফেকি করেছেন। তিনি ১৫ দিনের সময় নিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ১৫ দিনের মধ্যে তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন, আমেরিকা সরাসরি ইরান আক্রমণ করবে কিনা। কিন্তু ১৫ দিন দূরের কথা, ৪৮ ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই তিনি সেই ভয়াবহ বিমান আক্রমণটি করলেন। তবে কথায় বলে, সেরের ওপরে আছে সোয়া সের। ইরান তার মতলব বুঝে ফেলেছিল বলে ১৩ জুন ইসরাইলের আক্রমণ শুরু হওয়ার আগেই তারা পারমাণবিক সাজ-সরঞ্জাম সরিয়ে ফেলেছিল। প্রশ্ন হলো, আমেরিকা তো আক্রমণ করতই। কিন্তু ১৫ দিনের পরিবর্তে ২ দিনের মাথাতেই এমন প্রচণ্ড হামলা করল কেন? এর উত্তর ডিফেন্স অ্যানালিস্টদের কাছে সহজ।
২.
বিষয়টি আপাতদৃষ্টে দুর্বোধ্য হলেও, যাদের এ সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞান আছে, তাদের কাছে বিষয়টি পানির মতো সোজা। সেটা বুঝতে হলে ইরান ও ইসরাইলের সামরিক শক্তি সম্পর্কে একটি ধারণা নিতে হবে। ইরানে নিয়মিত সৈন্য সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ ৮০ হাজার। এছাড়া সাড়ে তিন লাখের মতো রিজার্ভ সৈন্য আছে। ইসরাইলের নিয়মিত সৈন্য সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ ৭০ হাজার এবং ৪ লাখ ৬৫ হাজার রিজার্ভ সেনা রয়েছে। ইরানের প্রায় ১৯৯৬টি ট্যাংক এবং ৬৫ হাজার ৭৬৫টি সাঁজোয়া যান রয়েছে। ইসরাইলের ১৩৭০টি ট্যাংক এবং ৪৩ হাজার ৪০৩টি সাঁজোয়া যান আছে।
ইসরাইলের কাছে মোট সামরিক বিমান রয়েছে প্রায় ৬০০ থেকে ৬৫০টি, যার মধ্যে ২৪১টি যুদ্ধবিমান। তাদের অ্যাটাক হেলিকপ্টারের সংখ্যা ৪৮টি। ইরানের হাতে মোট সামরিক বিমান রয়েছে প্রায় ৪০০ থেকে ৫৫০টি, যার মধ্যে ১৮৬টি যুদ্ধবিমান। অ্যাটাক হেলিকপ্টারের সংখ্যা ১৩টি। ইরানের রয়েছে ১৯টি সাবমেরিন। ইসরাইলের ৫টি।
গত ২০/২৫ বছর ধরে ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকা এবং পশ্চিমা বিশ্ব লাগাতার অর্থনৈতিক, সামরিক ও প্রযুক্তিগত নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে এ অজুহাতে যে, ইরান নাকি পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ করছে। এ পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ থেকে বিরত রাখার জন্যই আমেরিকা সেদিন ইরানে ভয়াবহ বিমান হামলা চালিয়েছে। অথচ যাদের পক্ষ হয়ে আমেরিকা সরাসরি যুদ্ধে নামল, সেই ইসরাইলের হাতে ৯০ থেকে ১০০টি পারমাণবিক বোমা রয়েছে। ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের নজির এর চেয়ে বড় আর কী হতে পারে!
- ট্যাগ:
- মতামত
- বিমান হামলা
- ইরান-ইসরায়েল সংকট