জগন্নাথ অর্থাৎ জগতের নাথ। পরমেশ্বর ভগবানের করুণাঘন এক অপূর্ব রূপ। জগন্নাথধাম হিন্দুজাতির চার ধামের এক ধাম। দেবীর একান্ন পীঠের এক পীঠ। জগন্নাথদেবের বিগ্রহ দৃশ্যত অসম্পূর্ণ, কিন্তু তাঁর দৃশ্যমান হস্ত, পদ না থাকা সত্ত্বেও তিনি হস্ত-পদময়।
কারণ, এ জগতে এবং সব জীবের মাঝেই তাঁর প্রকাশ। আবার তিনি এ জগত এবং সব ইন্দ্রিয়ের ঊর্ধ্বে। ইন্দ্রিয়, বাক্য, মনের অগোচর হয়ে সদা বিরাজিত হয়ে আছেন তিনি।
গোটা ভারতবর্ষে যত প্রাচীন মন্দির আছে তার প্রত্যেকটি মন্দিরে বিগ্রহেরই কিছু স্বতন্ত্রতা আছে। তেমনি স্বতন্ত্রতা জগন্নাথ বিগ্রহের। অপরূপ করুণাঘন চখা-চখা চোখে তাকিয়ে আছেন ভগবান ভক্তের পানে।
স্কন্ধপুরাণের বিষ্ণুখণ্ডের পুরুষোত্তম ক্ষেত্র মাহাত্ম্যের এক থেকে সাতান্ন অধ্যায়ে জগন্নাথদেবের এমন রূপের কারণ দেওয়া আছে অত্যন্ত সুন্দর করে। সেই মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন, রাণী গুণ্ডিচা এবং বৃদ্ধ কারিগরের এ ঘটনাটা আমরা সবাই মোটামুটি জানি। তাই সেদিকে আর আমি যাচ্ছি না।
জগন্নাথদেব সনাতন হিন্দুর শাক্ত, শৈব, গাণপত্য, সৌর এবং বৈষ্ণব এ পঞ্চ মতেরই একত্বের প্রতীক। বলদেব শিবের, শুভদ্রা শক্তির, জগন্নাথ বিষ্ণু, আর সুদর্শন সূর্যের প্রতীক বলে উপাসনা করা হয়। পঞ্চমতের মধ্যে বাকি রইল একটি গাণপত্য। তাই স্নানযাত্রার দিনে জগন্নাথদেবকে গণেশরূপে উপাসনা করা হয়।
আবার জগন্নাথদেবের যেহেতু দৃশ্যমান হস্ত-পদ নেই, তাই তিনি হস্ত-পদের ঊর্ধ্বে ব্রহ্মস্বরূপ এবং তাঁর বিগ্রহকে বলা হয় দারুব্রহ্ম। তান্ত্রিকমতে জগন্নাথকে শক্তিপীঠের অধিষ্ঠাত্রী দেবী বিমলার ভৈরব হিসেবে পূজা করা হয়। বৈদিক, তান্ত্রিক সব মতেই জগন্নাথদেবকে পূজা করা হয়।
জগন্নাথদেবের মন্দির শুধুমাত্র হিন্দুদের সব মত-পথের একতার প্রতীকই নয়; হিন্দু জাতির একতা গঠনে তিনি অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। জগন্নাথদেবের গর্ভগৃহে সব হিন্দুদেরসহ ভারতে উৎপন্ন বৌদ্ধ, জৈন, শিখসহ সব ধর্মাবলম্বীদেরই প্রবেশের অধিকার রয়েছে। শুধুমাত্র সেমেটিক ধর্মাবলম্বীদের প্রবেশাধিকার নেই।
জগন্নাথদেবের প্রসাদ ব্রাহ্মণ-শূদ্র নির্বিশেষে সবাই এক সাথে, এক পাতে বসে গ্রহণ করে। যেখানে জগন্নাথদেবের প্রসাদ পাওয়া যায়, সেই স্থানের নাম আনন্দবাজার। অপূর্ব নামকরণ! এ যেন একতার আনন্দবাজার। এ যেন জাত-পাতের রাজনীতিকে একপাশে রেখে হিন্দুত্বের মিলনের আনন্দবাজার।
জগন্নাথদেবের পূজা হয় দ্বৈতভাবে, ব্রাহ্মণ পাণ্ডাদের রীতিতে এবং শূদ্র শবরদের রীতিতে। সবাই সমান সমান অংশগ্রহণকারী জগন্নাথদেবের উপাসনায়। জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রার পরের ১৫ দিনকে বলা হয় অনসর-পিড়ি; এ সময়ে শবর বিশ্বাবসুর বংশধর শূদ্র দয়িতাপতিরাই জগন্নাথদেবকে পূজা করেন।
সাধারণত দেবতা থাকেন মন্দিরে আর ভক্তরা এসে বিগ্রহকে প্রণাম করে, উপাসনা করে। কিন্তু জগন্নাথদেব এর ব্যতিক্রম, তিনি সাধারণের মাঝে সাধারণজন হয়ে রাজপথে নেমে এসেছেন। তিনি তো রাজাধিরাজ তিনিই যখন নেমে এসেছেন রাজপথে, তখন দেশের রাজার তো সাধ্য নেই রাজসিংহাসনে বসে থাকার।