অনুবাদক- মোহাম্মদ নাসির আলী
প্রচ্ছদ- এনায়েত রসুল
মূল্য-২৫ টাকা
প্রকাশকাল-জুলাই ১৯৮৭
আমাদের শিশুসাহিত্যের ভাণ্ডারকে ভরে তোলার জন্য এবং সাহিত্যের এ বিভাগটিকে একটি পরিপূর্ণ চেহারা দেওয়ার জন্য যেসব শিশুসাহিত্যিক আজীবন কাজ করে গেছেন মোহাম্মদ নাসির আলী ছিলেন তাদের অন্যতম। ক্ষুদে পাঠকদের জন্য নাসির আলী যত লিখেছেন, অন্য কোন শিশু সাহিত্যিকের পক্ষে লেখা সম্ভব হয়নি। নিভৃতে থাকা এই লোকটি জন্মগ্রহণ করেছিলেন তৎকালীন ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগণার ধাইদা গ্রামে, ১৯১০ সালের ১০ জানুয়ারী আর মৃত্যবরণ করেন ৩০ জানুয়ারী ১৯৭৫ সালে।
ছোটদের জন্য তিনি লিখেছেন লেবু মামার সপ্তকান্ড, বোকা বকাই, ভিনদেশি বীরবল, বুমেরাং ইত্যাদি। এই গুনি লেখক ১৯৬৭ সালে বাংলা একাডেমী পুরষ্কার সহ অনেক পুরষ্কার লাভ করেন। “তলস্তয় আর সেরা গল্প”মোহাম্মদ নাসির আলির এক অভূতপূর্ব সৃষ্টি। এটি একটি অনুবাদকৃত বই। “তলস্তয় আর সেরা গল্প” এই বইটিতে মোট ছয়টি গল্প রয়েছে। এক টুকরো রুটি,শিশুর সরলতা,জমির মায়ায়,আগুনের একটি কণা, বিধাতা সবই দেখতে পান, তিনটি প্রশ্ন। সুপাঠ্য বই গুলো সাথে ভাবনার খোরাকও যোগাবে বৈকি।
এক টুকরো রুটি-
এক টুকরো রুটি গল্পটি গ্রামের এক সৎ কৃষক কি ভাবে শয়তানের প্রচনায় অসৎ হয়ে যায় তা নিয়ে লেখা। কৃষকটি একদিন জমি চাষ করতে ছিল আর তার পাশেই খাবারের জন্য রুটি রেখেছিল। যখন খিদে পেল খেতে গিয়ে দেখে রুটি নেই। পাশে ঝোপের আড়ালে শয়তান হাসছিল যে মানুষ রেগে গিয়ে কি ভাবে শতানের দলে আসে দেখার জন্য। রুটির টুকরোটি হারিয়ে চাষি ভাবতে লাগলো একবেলা না খেলে আমি মারা যাবনা, তাই সে চুপ চাপ থাকল। অন্য দিকে শয়তান এই কথা গুলো তার সরদারকে বলল।
এইবার রাখাল বেশে এসে শয়তান কৃষকের বাড়িতে কাজ নিলো। তার লক্ষ্য ছিল যে কি ভাবে ভালো মানুষদেরকে শয়তানের দলে ভেড়ানো যায়। একবার সে মনিব কে বুদ্ধি দিল যে নিচু জমিতে ফসল ফলাতে।সেবার বৃষ্টি কম হওয়ায় খুব ভাল ফসল পেলো কৃষক। এই ভাবে কয়েক বার বিভিন্ন বুদ্ধি দেয়ায় কৃষকের বরং লাভই হল। অল্প কয়েক দিনে কৃষকটি অনেক ফসলের মালিক হয়ে উঠলো।
পরবর্তীতে শয়তান কৃষককে ভদকার দোকান দিতে বলে যাতে কৃষকটি খারাপ এবং শয়তানের দলে পৌঁছে যায়। এইবার শয়তান সফল হলো। ভালো মানুষ কৃষক দিন দিন লোকটি নেকড়ে, শুয়োরের মত হতে থাকে এবং শয়তানের সর্দার আনন্দে হাত তালি দিতে থাকে। যখন থেকে ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ দান এই ফসলকে মদে পরিণত করতে লাগলো, তখন থেকেই কৃষকের ভিতরের জানোয়ার ভাবটা প্রকাশ পেতে শুরু করল।
শিশুর সরলতা-
বড়দিন পর্ব শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে রাস্তায় প্রচণ্ড তুষার জমে ছিল। দুটি বাড়ির সরু গলির মধ্য বরফ গলে যাওয়া পানিতে দু জন মেয়ে খেলা করছিল নিজেদের মনে। দু’ জন দুই বাড়ির মেয়ে। একজন আকুলিয়া অন্য জন মালাশা। পানির মধ্য খেলতে গিয়ে আকুলিয়ার জামায় ময়লা পানি লেগে যায়। আর তাতে আকুলিয়া ভয় পেয়ে বাড়ির দিকে দৌড় দেয়। আকুলিয়ার মা মেয়ের ময়লা জামা কাপর দেখে জানতে চাইলে সে বলে যা মালাশা তার গায়ে পানি ছিটিয়ে দিয়েছে।
আকুলিয়ার মা মালাশার মায়ের সাথে এই তুচ্ছ একটা ব্যাপার নিয়ে শুরু করেন বিশাল ঝগড়া। ঝগড়ার এমন পর্যায়ে যে কখন যেন মারা মারি লেগে যায় অবস্থা, তখন আকুলিয়ার বুড়ো দাদী বেরিয়ে এসে সবাইকে শান্ত হওয়ার জন্য বলেন। কিন্তু কেউ তার কথা না শুনে ঝগড়া চালিয়ে যেতে থাকে।
অবশেষে ঝগড়া থেমে যায় মালাশা আর আকুলিয়ার কারনেই। কোন ফাঁকে আকুলিয়া ময়লা কাপড় ধুয়ে দিয়ে এসে আবার পানিতে নেমেছে। আর আকুলিয়ার খেলার সঙ্গী মালাশা তার সাথে উচ্চ স্বরে কথা বলছে ও হাসছে। মালাশা লাঠিটা ধরো বলে চিৎকার করছে আকুলিয়া। এই দেখে মায়েদের ঝগড়া থেমে গেছে। কত না আনন্দ প্রিয় এই শিশু গুলি, সব কিছু ভুলে গিয়ে কত না মজা করতে পারে ওরা। এটাই এই গল্পের মূল বিষয়।
বিধাতা সবই দেখতে পান-
রাশিয়ার এক শহরে বাস করতো আকসেনভ নামের এক যুবক। পেশায় ছিল ব্যবসায়ী, আর ছিল দু খানা দোকান ও বসত ভিটা। ছোটবেলা থেকে নেশা করলেও এখন সে পুরাপুরি ভালো, মাঝে মাঝে কেবল ভদকা খেয়ে নেশা করে। গ্রীষ্মের এক সকালে ব্যবসার কাজে শহরে যাওয়ার জন্য বের হয় যুবক। স্ত্রী তাকে বলে যে ,আমি খুব একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছি তুমি আজ শহরে যেওনা। সে উপেক্ষা করে শহরে যায় এবং রাস্তার মাঝে পরিচয় হয় এক ব্যবসায়ীর সাথে। দু’ জনেই রাতে এক সরাই খানাতে থাকে।
পরদিন সকাল বেলা আকসেনভ সরাই খানার সব লেনদেন চুকে দিয়ে বের হয়। প্রায় মাইল পঁচিশ যাবার পর সে আরেকটা সরাই খানাতে দাঁড়িয়ে পড়ে ঘোড়া গুলোকে কিছু খাইয়ে নেবার জন্য। কিছুক্ষণ পর একজন অফিসার এসে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু করে। সে সবগুলো প্রশ্নের উত্তর দিলেও মূল ঘটনা বুঝে উঠতে পারেনা। অফিসার আকসেনভকে বলে যে, যে লোকটির সাথে আপনি আপনি রাতে ঘুমিয়ে ছিলেন সে খুন হয়েছে। আর আমি একজন পুলিশ অফিসার। আপনার পোটলা তল্লাসী করব।
যেই বলা সেই কাজ। আকসেনভের ব্যাগ তল্লাসী করে একটা রক্ত মাখা ছোরা পাওয়া গেল। ছোরাতে কেন রক্ত লেগে আছে জিজ্ঞেস করলে আকসেনভ কোন উত্তর দিতে পারেনা। সে শুধু বলে আমি কিছু জানিনা। আমি খুন করিনি।
বিচার শুরু হলো, তার কারাদণ্ড হল। একদিন তার স্ত্রী তাকে দেখতে এসে জানতে চাইলো সে আসলেই খুন করেছে কি না? রাগে দুঃখে আকসেনভ মুখ সরিয়ে নিল এবং বলল তুমিও আমাকে অবিশ্বাস করলে? এরপর সে মুক্তির আশা ছেড়ে দিয়ে শুধু আল্লাহ্কে ডাকতে লাগলো। স্ত্রী বলল সেদিন আমি তোমাকে শহরে যেতে নিষেধ করেছিলাম,বলে মাথায় চুল গুলোতে হাত বুলিয়ে চলে আসলো। দীর্ঘ ২৬ বৎসর তার খুব কদর ছিল সাইবেরিয়ার কারাগারে বন্দী অবস্থায়। রাত দিন কাটে তার প্রার্থনা করেই। চুল দাড়ি সব সাদা হয়ে গেছে।��ারাগারে ভাল মানুষ হিসেবে তার খুব কদর ছিল। সবাই আকসেনভকে বুড়ো দাদু বলে ডাকতো।
নতুন একজন কয়েদী সায়বেরিয়ার জেল খানায় নতুন এসেছে। ষাট ঊর্ধ্ব বয়স তার, একদিন সবাইকে শোনাচ্ছিলেন কি ভাবে বিনা দোষে হাজতে আসলেন। আকসেনভ তার কথা শুনতে ছিলেন। এক সময় পরিচয়ের ফাঁকে জানতে পারেন যে এই নতুন কয়েদীটির বাড়ি তার নিজের শহরে। তারপর আকসেনভ তার পরিবার সম্পর্কে জানতে চান। নতুন কয়েদী মাকার সবাইকে চেনে এবং তারা এখন অনেক ধনী তাও আকসেনভকে জানায়। মাকার জানতে চায় সে কি ভাবে জেলে এলো। আকসেনভ না বললেও অন্য অন্য কয়েদীরা মাকারকে তার মিথ্যে মামলার কথা জানায়। মাকার বলে, তুমি এরকম বুড়ো হয়ে গেছো কেন? আকসেনভও মাকারের সাথে বিভন্ন কথা বার্তার মাঝে বুঝে ফেলে যে এই খুনের ব্যাপারে মাকার জানে এবং খুনিটা সে নিজেও হতে পারে।
এরপর আরও কিছুদিন তাদের জেল খানায় কেটে যায়। মাকার আরেকটি অপরাধ কারাগারে করে ফেলে যার এক মাত্র সাক্ষী আকসেনভ। কিন্তু বিচারের সময় সে মুখ খোলে না। এই দেখে মাকার তো অবাক, এত ভাল একজন মানুষ তার জন্য কষ্ট ভোগ করছে, এটাই ভাবে কেবল। মাকার আকসেনভকে গিয়ে সব কিছু খুলে বলে তাকে ক্ষমা করে দেবার জন্য বলে। আকসেনভ জবাব দেয়, তোমার জন্য আমি ২৬ টি বৎসর জেলের মধ্যও, এখন বলে আর কি লাভ? আমি কি আমার সন্তানদের মাঝে যেতে পারবো? আমার স্ত্রী তো মারা গেছে অনেক আগে? কোথায় যাব আমি বলতে পারো? অবশেষে মাকার তার নিজের সব দোষ আদালতে স্বীকার করে,যদিও আকসেনভ মুক্তি চায়নি। আকসেনভের মুক্তির আদেশ তার কাছে আসার আগেই সে সবাইকে মুক্তি দিয়ে চলে গেছে পরপারে।
মোহাম্মদ নাসির আলীর অসাধারন অনুবাদ “তলস্তয় আর সেরা গল্প” বইটি। মজার এবং উপদেশ মুলক এই গল্প গুলো পড়ে নিন খুব শীঘ্রই।