ছবি সংগৃহীত

ঈদেও হাসি নেই বৃদ্ধাশ্রমের মলিন মুখগুলোয়...

Dipanbita
লেখক
প্রকাশিত: ১৮ জুলাই ২০১৫, ১৫:০১
আপডেট: ১৮ জুলাই ২০১৫, ১৫:০১

ছবি: রাজীন চৌধুরী (প্রিয়.কম) দীর্ঘশ্বাসের বাষ্প জমে ঘোলা হয় চােখ, চশমার কাঁচ মুছেও নাগাল পাওয়া যায় না অপেক্ষার শেষ প্রহর, এখানে ক্যালেন্ডারের পৃষ্ঠাগুলো যেন উপহাস করে বিরামহীন ঘড়ির কাঁটাগুলোকে। বিস্মৃতির আড়াল হাতড়ে নিজেকে খুঁজে বেড়ানোই এখানে একমাত্র বিনোদন। সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, উদরপূর্তি, ঘোরলাগা ঘুম আর প্রতিনিয়ত নির্বাক অপেক্ষাই এখানে দৈনন্দিন রুটিন। জীবন যেখানে থমকে গেছে বয়সের বেড়াজালে, যেকোন দিন কিংবা ঈদ- বদলায় না বৃদ্ধাশ্রমের ছকবাঁধা এ রুটিনের দৃশ্যপট। বয়সের ভারে ন্যুজ মানুষগুলো ঈদের দিনেও অপেক্ষা করেন না তাদের সন্তান, পরিবার কিংবা দর্শনার্থীর। প্রশ্নের উত্তরে স্পষ্ট উচ্চারণ- এখন একমাত্র অপেক্ষা ওপারে যাওয়ার।

বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরা বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান নিবাস- সহজ কথায় বৃদ্ধাশ্রম। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা প্রতিষ্ঠিত এবং ব্যস্ত সন্তানদের ভরসাকেন্দ্র, বৃদ্ধ বাবা মায়ের বোঝা খুব সহজেই এই নিবাসের ঘাড়ে চাপিয়ে ফেলতে পারেন স্বস্তির নিঃশ্বাস। পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন, হয়তো মানুষ করতে পারেননি তবে লেখা পড়া শিখিয়ে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে পরিনত করেছেন- তার বিনিময়ে মাসে মাসে কিছু টাকা গোনা কঠিন নয়। না, এখানে বসবাসরত প্রবীন ব্যক্তিরা অসহায়- এমনও নয়। প্রাক্তন ব্যরিস্টার, বড় সরকারী চাকুরে, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশায় স্বাক্ষর রেখেছেন একসময়। প্রয়োজনে কিংবা নিতন্ত শখে ঘুরেছেন দেশে বিদেশে। অথচ সময়ের পরিবর্তনে তিনি তথাকথিত সমাজে অপ্রয়োজনীয়। বয়স তার কাছে আর অভিজ্ঞতা নয়- অভিশাপ। বৃদ্ধাশ্রমের ঘরের চার দেয়াল কিংবা তারচে একটু বেশি- বারান্দা করিডোরেই সীমিত তার বিশ্ব। ছেলে, মেয়ে, পরিবার, স্বজনের আন্তরিক সৌহার্দ্য নয়- টাকার বিনিময়ে নিবাসের আয়া, বয়, বাবুর্চির সেবায় দিন কাটে তাদের।
১৯৬০ সালে ব্যক্তি সদিচ্ছায় প্রতিষ্ঠিত হয় এই বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ। ব্যক্তিমালিকানাধীন সংস্থাটি কালে কালে বদলে গেছে- বর্তমানে ট্রাস্টি, ডোনার এবং সরকারী অনুদানেই চলছে। ১৪৫ জন সদস্যকে নিয়ে চলছে নিবাসটি। কেবিন ও ওয়ার্ড- দুই ধরনের থাকার ব্যবস্থা। কেবিনে ৪০০ টাকার বিনিময়ে একাই থাকা যায় এক ঘরে। আর ২০০০ টাকা দিয়ে একজন রুমমেট নিয়ে চলে ওয়ার্ড। কিন্তু খাবার ব্যবস্থা ভিন্ন। মেস সিস্টেমে বাজার হলে রান্না করেন সংস্থার বাবুর্চি। অনেকে অবশ্য নিজেও রান্না করে খান। চিকিৎসার জন্য রয়েছে হাসপাতাল।
নিবাসে ঢুকতেই চোখে পড়ে খালি বারান্দা- পড়ে আছে কয়েকটি হুইলচেয়ার। চলৎশক্তিহীন অনেক সদস্যই আছেন এখানে- সন্তানের বাসায় স্থান হারিয়ে টাকার বিনিময়ে হলেও একমাত্র আশ্রয়। ৫৫ বছর বয়স না হলে এই বৃদ্ধাশ্রমে থাকা যায় না, হুইল চেয়ার তাই অনেকেরই ভরসা। প্রতিদিনের মত ছড়ানো ছিটানো চেয়াগুলো আজ ঈদের দিনেও ফাঁকা, দর্শনার্থীর অভাবে নিবাসের ৩টি ফ্লোর নিস্তব্ধ। কয়েকটি ঘরের দরজা খোলা- বাতাসে উড়ে যাওয়া পর্দা দেখিয়ে দেয় অভ্যন্তরের চিত্র। নিতান্ত প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র, শুকনা খাবার, জামা কাপড় এবং বিছানার সঙ্গে আটকে থাকা মশারীর সঙ্গে মানানসই শারীরীক অবয়ব। খোলা বইয়ের পাতায় একান্ত মনোযোগ। একটু মন দিলে দেখলেই দেখা যায় ষাটোর্ধ নারী নিবিষ্ট হয়ে দেখছেন পুরানো অ্যালবাম। অনুমতির জন্য তার মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটাতে ইচ্ছা হয় না, অনধিকার অনুপ্রবেশর অপরাধটুকু স্বীকার করেই পিছু ফিরি।
এই নিবাসে ঈদ উপলক্ষ্যে রান্না হয়েছে বিশেষ খাবার- সংস্থার ৩০০০০ টাকা দিয়ে পােলাও, মুরগীর রোস্ট, সালাদ, খাসির মাংস খাবে সদস্যরা। 'এই খাবার রান্নাই শেষ- এই খাওয়া বেশীরভাগ সদস্যদের নিষেধ।'- বললেন চম্পা খালা, তিনি এই নিবাসে রান্না করছেন প্রায় ৩ বছর ধরে। তিনিই জানান, এখানে কোন ডাইনিং রুম নেই কারণ ঘর থেকে ডাইনিংয়ে এসে খাওয়ার মত শক্তি নেই অনেকের। আবার অনেকেই সবার মধ্যে বসে খেতে পছন্দ করেন না। এমনও অনেকে আছেন- কারো সঙ্গে না পারতে কথা বলেন না।
কথা বলতে গিয়ে বেশিরভাগ সদস্যই বিরক্ত হন। 'ঈদ? তো কি হইছে? আচ্ছা ঠিক আছে, ঈদ মোবারক। পরিবার? আমার পরিবার দিয়া আপনার কি দরকার? নাই নাই- থাকলে কি এখানে থাকি?'- তিনি সালেহা চৌধুরী (ছদ্মনাম), অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষিকা। চম্পা খালাই জানান- ছেলে মেয়ের কথা বললেই ক্ষেপে যান তিনি। কিন্তু কেন? তাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে সন্তানরা হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন, তাই? নাকি সন্তানকে মানুষ করতে পারেননি বলে জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ? তবে কিছুটা কথা বলেন একজীবনের আইনজীবী জলি- ডাকনাম টুকু বলতেই রাজি তিনি। দুপাশ খোলা বারান্দায় বেঞ্চে বসে আছেন হালকা চাদর জড়িয়ে। জানালেন, মেয়ে দেশের বাইরে থাকে। আর ছেলে-বউমা দুজনেই ব্যস্ত মানুষ। বাসায় বুয়া আয়া দিয়ে ঠিকমতো দেখভাল হয় না- এই অজুহাতে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গেছেন। তিনি উচ্চারণ করেননি, তবুও তার ভ্রুকুটিতে একটাই প্রশ্ন- এখানে দেখভাল করছে কে?
হাসপাতালের সুযোগ সুবিধা দেখতে গিয়ে ঈদ উপলক্ষ্যে বন্ধ পাওয়া গেল সব ঘর, নোটিস বোর্ডে ঝুলছে এই বন্ধের নোটিস। চারতলার বারান্দা থেকে নিবাসের দিকে তাকালেই অনুভূতিতে আঘাত হানে গুমরে ওঠা দীর্ঘশ্বাস। আবারও নিবাসে ফেরার পথে সিড়িতে দেখা হয়ে দুজন দর্শনার্থীর, দুই ভাই বোন। একজন পড়াশোনা এবং অন্যজন পেশাগত কারণে থাকছেন বিদেশে। মা মারা যাওয়ার পরে একরকম বাধ্য হয়েই বাবাকে রেখেছেন এই নিবাসে। 'প্রথমে আত্মীয় স্বজনের উপর নির্ভর করেছিলাম। কিন্তু তাদের মূল ইন্টেনশন টাকা। অনেক ভেবে বাবাই এই নিবাসের কথা বললেন। দুই ভাই বোন বিদেশে আছি, খুব তাড়াতাড়ি বাবাকেও নিয়ে যাবো। এবার দেশে এলাম সে ব্যবস্থা করতেই।'- নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দর্শনার্থীদের সঙ্গে কথা বলে তবুও কিছু স্বস্তি পাওয়া যায়। কারণ দুপুর ১২ থেকে বিকাল ৩ টা পর্যন্ত অন্য কোন দর্শনার্থীর দেখা মেলেনি।
ঘরের দরজা থেকে বারান্দার চেয়ার- মাত্র দুই পায়ের দূরত্ব। এটুকু পথ পাড়ি দিতেই অনেকটা সময় নিলেন প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাবেক সদস্য বজলুর রহমান, তবে সাহায্য নিলেন না। সকালে সেমাই খেয়েছেন? প্রশ্নের উত্তরে কঠিন স্বরে বললেন- 'আমি সেমাই খাই না'। আজ ঈদের দিন- কেউ দেখা করতে আসে নি? এবার কিছুটা কোমল হলেন, 'ভাই, বোন আর সংসার চালাতে গিয়ে বিয়ে করিনি। সবাই বড় হয়েছে, পরিবার হয়েছে। আর আমি পরিবার থেকে ছিটকে গেছি আমি। ভালোই আছি, অন্যের দয়া না নিয়ে পেনশনের টাকায় চলি।' গাড়ীর হর্ন শুনে উন্মুখ হয়ে তাকান- গাড়ী থেকে নেমে এলেন বৃদ্ধ এক ব্যক্তি। 'বাপরে ঈদের দিন সকালে দয়া করে নামাজে নিয়ে গেছিল। হয়তো বাসায়ও নিয়ে গিয়ে গেছিল। এখন আবার ফিরিয়ে দিয়ে গেছে। উনি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন।'- বললেন বজলুর রহমান।
আধো আঁধারে মাথা নিচু করে বসে আছেন একজন বৃদ্ধা। কাছে গেলে বলেন- 'কি? আমার কোন প্রবলেম কিনা জানতে এসছো? ইউনিভার্সিটির? নাকি নিউজপেপারের?' প্রশ্নের তোড় থামতেই বললাম- 'ঈদ মোবারক বলতে এসছি'। কিছুটা তাচ্ছিল্যের হাসি ঠোঁটে রেখেই বললেন, 'এখানে কেউ টাইম পাস করার জন্য আসে না। হয় নিডস, না হয় সিমপ্যাথি। বাট উই ডোন্ট নিড সো কলড সিমপ্যাথি। হ্যাঁ, আম ফাইন উইথ মাই লাইফ হিয়ার। ইজ ইট ক্লিয়ার?' নতুন করে বিরক্ত করার ইচ্ছা হলো না। তবে রান্নাঘর, বাথরুম, বিছানা, ঘরের মেঝে- পরিচ্ছন্নতা নিয়ে প্রশ্ন করলে স্পষ্ট গলায় বললেন- 'যাও, নিজেরাই দেখে আসো'।
বাংলাদেশ প্রবীন হিতৈষী সংঘ ও জরা বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠানের এই নিবাসের প্রচেষ্টার প্রতি সম্মান রেখেই বলছি- অস্বাস্থ্যকর বাথরুম, রান্নাঘর, ঘরের মেঝে। জায়গায় জায়গায় জমে আছে ময়লা। অব্যবহৃত আসবাবপত্র, ব্যাগ, বিছানা, বালিশ পড়ে রয়েছে সিড়িতে। বাথরুমের অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ এবং জমে থাকা আবর্জনা দূর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। রান্নাঘরের সিংক, পানির ট্যাংক ইত্যাদির পাশে তেলাপোকার ঘরবসতি। এমন পরিবেশে থাকার জন্যই কি সন্তানদের বড় করে তুলেছেন তারা? তবে কি ভুল ছিল সন্তানদের পথপ্রদর্শনে? নাকি নিজের স্বার্থ ও ভবিষ্যতের ভাবনা না ভাবার পরিনতি ভোগ করছেন তারা?
নিবাসে ঢোকার আগেই সতর্ক করা হয়েছিল- 'ছবি তুইলেন না'। তাই মানতে হয়েছে কিছুটা গোপনীয়তা। বেরিয়ে অাসার সময় দেখা হল এক পরিবারের সঙ্গে। বয়স্ক এক নারীর সঙ্গে আরও দুজন। পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে ভাবলাম, মা কে ফিরিয়ে দিতে এসেছে নিরালা আবাসে। কিন্তু না- স্বামী, মেয়ে ও শাশুড়ীকে নিয়ে খালা শাশুড়ীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন মনিপুরি পাড়ার রুনা। এটুকু মানবতার দামটাই যে নিঃসঙ্গ নারীর কাছে অমূল্য- এ কথা কি জানেন নিবাসের সদস্যদের সন্তান কিংবা তথাকথিত স্বজন?