নতুন সরকারকে যে অগ্রাধিকার নিশ্চিত করতেই হবে
দুই মাসের কম সময়ে বাংলাদেশ একটি জাতীয় নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই দেশের কথাবার্তা, আলোচনা ও বিতর্ক রাজনৈতিক বিষয়গুলো নিয়েই আবর্তিত হচ্ছে; কিন্তু যখন নির্বাচন শেষ হবে এবং একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করবে, তখন প্রশাসনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে দেশের অর্থনীতি।
এ বিষয়টিই নতুন সরকারের জন্য সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। কারণ, অন্য সব বিষয় বাদ দিলেও অর্থনীতিই সাধারণ মানুষের মনে সবচেয়ে চিন্তার বিষয়। যার মধ্যে মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব, সুযোগের অসমতা, ঋণ, মৌলিক সামাজিক সেবার গুণগত মান, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও মব সহিংসতা রয়েছে। তবে এটি তালিকা দীর্ঘ। সুতরাং, স্বাভাবিকভাবেই নতুন সরকারের কাছে এটা প্রত্যাশিত যে অর্থনীতিই তাদের অগ্রাধিকার পাবে।
শুরুতেই তিনটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট হওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, অর্থনীতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, এই অঙ্গীকার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সেই অঙ্গীকারে কোন কোন বিষয় অগ্রাধিকার পাবে, সেটিও চিহ্নিত হওয়া প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, অন্তর্বর্তী সরকারের অঙ্গীকার ও চিহ্নিত অগ্রাধিকারগুলোকে নতুন সরকার তাদের নীতিমালায় যুক্ত করবে। তৃতীয়ত, ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই ক্ষমতাসীন দলটিকে বাংলাদেশের জন্য মধ্যমেয়াদি একটি অর্থনৈতিক রূপরেখা প্রণয়ন করতে হবে।
বাংলাদেশ অর্থনীতির বর্তমান বাস্তবতা এবং এ অর্থনীতির ভবিষ্যতের নিরিখে অর্থনৈতিক এই রূপরেখায় তিন ধরনের সমস্যার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া দরকার—প্রবহমান সমস্যা, ঘনীভূত সমস্যা এবং আসন্ন সমস্যা। প্রবহমান সমস্যাগুলোর শীর্ষে রয়েছে দারিদ্র্য ও অসমতা। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিকট অতীতে দারিদ্র্য দূরীকরণে বাংলাদেশের অর্জনের অনেকটাই সাম্প্রতিক সময়ে খোয়া গেছে।
২০১০ থেকে ২০২২ সাল—এই ১২ বছরে বাংলাদেশ তার জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩ কোটি ৪৯ লাখ মানুষকে দারিদ্র্যসীমার ওপরে নিয়ে আসতে পেরেছিল; কিন্তু গত তিন বছরে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার আবার ১৮ শতাংশ থেকে ২১ শতাংশে উঠে গেছে। আজ দেশের ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে।
আমাদের অর্থনীতির একটি অন্যতম বাস্তবতা হচ্ছে অসমতা ও বৈষম্য। বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০২২ অনুযায়ী, দেশে অনূর্ধ্ব ৫ বছর বয়সী শিশুমৃত্যুর গড় হার হাজারে ৩১ জন। ধনী ও দরিদ্র পরিবারের মধ্যে ব্যবধান থাকলেও দরিদ্রতম ২০ শতাংশ পরিবারের ক্ষেত্রে এই হার সাধারণত হাজারে ৪৫ থেকে ৫০ জনের আশপাশে থাকে।
দ্বিতীয় চলতি সমস্যাটা হচ্ছে স্বাস্থ্য, শিক্ষার মতো দেয় মৌলিক সামাজিক সেবার নিম্নমান। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত পরিমাণগত দিক থেকে সম্প্রসারিত হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু সেসব অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সেবার কোনো গুণগত পরিবর্তন হয়নি। শিক্ষার ক্ষেত্রে জ্ঞান কিংবা দক্ষতা অর্জন নয়; বরং সনদপ্রাপ্তিই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাস্থ্য খাতের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, উচ্চ মানসম্পন্ন সেবা দেওয়া নয়। দুটি খাতেই উচ্চ মানসম্পন্ন সেবাগুলো সংরক্ষিত থাকে ধণিক শ্রেণির জন্য এবং এ–জাতীয় বৈষম্যই বাংলাদেশের সমাজে অসমতা ত্বরান্বিত করার ব্যাপারে একটি চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে।
তৃতীয় সমস্যাটি হচ্ছে সঞ্চয়, বিনিয়োগ ও সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে একটি শ্লথতা। প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে সঞ্চয় হার অত্যন্ত কম। অতীত সময়ে বাংলাদেশ যথেষ্ট পরিমাণে বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারেনি। ভিয়েতনামের দিকে তাকালেই এ ব্যাপারে আমাদের ঘাটতি বোঝা যায়। বাংলাদেশে কর-জাতীয় আয়ের অনুপাত মাত্র ৮ থেকে ৯ শতাংশ, নেপালে ১৯ শতাংশ এবং ভারতে ১২ শতাংশ। বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবেই রপ্তানি করের মতো অপ্রত্যক্ষ করের ওপরে নির্ভর করেছে এবং সে নির্ভরতা এখনো প্রত্যক্ষ করের দিকে যায়নি।