‘তবু মাথা নোয়াবার নয়’
গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার চরম নিষ্পেষণমূলক ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের পতন ঘটানোর পর মানুষ উচ্ছ্বসিত হয়ে স্বপ্ন দেখছিল, বাংলাদেশ বুঝি এবার বাক্স্বাধীনতার অভয়ারণ্য হয়ে উঠল। ১৮ ডিসেম্বর রাতে সেই স্বপ্ন বাস্তবের কঠিন মাটিতে সশব্দে আছড়ে পড়েছে।
ঘটনা এমন অবিশ্বাস্য রোমহর্ষের মধ্য দিয়ে ঘটেছে যে মনে হবে হলিউডের ব্লকবাস্টার কোনো সিনেমার দৃশ্য। একদল উত্তেজিত জনতা এসে প্রথমে প্রথম আলো এবং পরে দ্য ডেইলি স্টার-এর অফিসে ভাঙচুর ও লুটপাট করে আগুন ধরিয়ে দিল। পরদিনের পত্রিকা বের করার জন্য ব্যস্ত সংবাদকর্মীরা যখন অফিসের ভেতরে মৃত্যুর আতঙ্কে কাঁপছেন, বাইরে তখন শোরগোল করছে উল্লসিত হামলাকারীরা। ঘটনাস্থলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে স্বল্প সংখ্যক সদস্য উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা ততক্ষণে সরে গেছেন। শেখ হাসিনার প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে কোনোমতে টিকে থাকা এই পত্রিকাগুলোর দুটো ভবন তখন দ্রুত পুড়ে ছাই। সংবাদমাধ্যম দুটোর অনলাইনের কার্যক্রম তৎক্ষণাৎ বন্ধ হয়ে যায়। পরদিন আমরা কোনো পত্রিকাও বের করতে পারিনি।
এরই মধ্যে অনেকেই তারিখটিকে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের জন্য ঘোরতর কালো দিন বলে আখ্যা দিতে শুরু করেছেন। ঘটনার সূত্রপাত অবশ্য আরও আগে, তবে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর। গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকেই গণতন্ত্রবিরোধী উগ্র দক্ষিণপন্থী কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী প্রথম আলোর বিরুদ্ধে পরিকল্পিত অপপ্রচার ও বিষোদ্গার শুরু করে। আর এর ঘনীভূত রূপ দেখা যায় গত বছরের নভেম্বর মাসে। সে সময়ে একদল লোক গরু জবাই করে তাদের ভাষায় ‘জেয়াফত’-এর আয়োজন করে প্রথম আলো অফিসের সামনে। কয়েক দিন ধরে চরম নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা ঘটায়। অতি সম্প্রতি দুঃখজনক হত্যাকাণ্ডের শিকার জুলাই আন্দোলনের সামনের সারির সংগঠক ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদি তখন বলেছিলেন, ‘প্রথম আলোর সামনে যারা দাঁড়িয়েছে, আমরা তাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছি? আমরা বলি, না! আপনি পারলে বিকল্প আরও দশটা প্রথম আলো তৈরি করেন। তার অফিসের সামনে আপনার কাজটা কী?’
ওসমান হাদির কথার ভেতরে ছিল জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অন্তর্ভুক্তির মর্ম। অথচ তাঁর নাম ভাঙিয়ে ঘটনা ঘটল উল্টো। তাঁর মৃত্যুশোকে কাতর মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে আক্রান্ত করা হলো প্রথম আলোকে। কী অভিযোগে? প্রথম আলো নাকি পতিত স্বৈরাচারের দোসর। ব্যাপক অপপ্রচার চালিয়ে মিথ্যা দিয়ে ঢেকে ফেলা হলো সত্যকে।