সত্য, সাহস ও ত্যাগের উত্তরাধিকার

যুগান্তর ড. মাহফুজ পারভেজ প্রকাশিত: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:৪৯

বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডলে আজ একটি অস্বস্তিকর বিভাজন স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে-একদিকে সত্য ও মানবিকতার পক্ষে সাহসের সঙ্গে দাঁড়ানো প্রকৃত বুদ্ধিজীবীরা, অন্যদিকে ক্ষমতার পাতে মুখ গুঁজে থাকা নতজানু চাটুকারদের দীর্ঘ সারি। এ দুই শ্রেণির উপস্থিতি কোনো নতুন ঘটনা নয়, সমাজের বিবর্তনে বারবারই দেখা গেছে সত্য ও ন্যায়ের কণ্ঠস্বরকে চাপা দিতে ভাঁড় ও বিদূষকদের ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে, সত্যকে কখনো দীর্ঘস্থায়ীভাবে দমন করা যায় না। যেমনভাবে ১৯৭১ সালের শহীদ বুদ্ধিজীবীদেরও মুক্তি ও স্বাধীনতার সড়ক থেকে সরানো যায়নি। জীবন দিয়ে তারা সত্য, সাহস ও আত্মত্যাগের অম্লান উপমা রেখে গেছেন। তাদের প্রতি পুরো জাতির বিনম্র শ্রদ্ধা।


সমাজবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, যে সমাজে ক্ষমতার সমালোচনা দুর্বল হয়ে পড়ে, সেখানে ভাঁড় ও বিদূষকের সংখ্যা বেড়ে যায়। তারা বিনোদন দেয়, হাসায়, ব্যঙ্গ করে। তাদের উদ্দেশ্য মানবিকবোধ জাগানো নয়, বরং ক্ষমতাসীনদের সেবাদানে তৈলমর্দনের সংস্কৃতি তৈরি করা। সদ্য পতিত ফ্যাসিবাদী আমলের বুদ্ধিজীবী নামধারী ভাঁড়, চাটুকার, পদলেহী, দলদাস ও বিদূষকের দল তৈলমর্দন ও লেজুড়বৃত্তির নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। এমনকি, ক্ষমতা হারানোর প্রাক্কালেও ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ড ঘটানোর উসকানি দিয়েছিল এ অসাধুচক্র।


প্রকৃত বুদ্ধিজীবী প্রতিকূল মুহূর্তেও সত্য বলা থেকে পিছপা হন না। তাদের কলম, ভাষণ এবং চিন্তা সমাজকে মানবিকতার পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। সাধারণ মানুষের পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে নিপীড়ন, অপবাদ কিংবা একাকিত্বকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেন। ক্ষমতা ও পদের মোহ তাদের স্পর্শ করতে পারে না। সুযোগ-সুবিধা তারা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। ধ্রুপদি পণ্ডিত সক্রেটিস ছিলেন তেমনি এক প্রকৃত বুদ্ধিজীবী, যিনি সত্যের পক্ষে দাঁড়িয়ে হেমলক পান করে আত্মত্যাগ করেছিলেন, আপস করেননি। প্রকৃত বুদ্ধিজীবীর নৈতিক দৃঢ়তার শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত আমরা খুঁজে পাই ১৯৭১ সালে। যে কারণে ১৯৭১-এর শহীদ বুদ্ধিজীবীরা স্মরণীয়।


বাংলাদেশের স্বাধীনতার শেষপ্রান্তে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, সাহিত্যিক, চিন্তাবিদ। তাদের হত্যা ছিল একটি জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার নিষ্ঠুর চেষ্টা। কিন্তু ১৯৭১-এর শহীদ বুদ্ধিজীবীরা মৃত্যুর মুহূর্তেও মানবিকতার পক্ষে যে দৃঢ়তা দেখিয়েছেন, তা চিরকালের অনুপ্রেরণার ঝরনাধারা। তাদের দর্শন, চেতনা ও বার্তা ছিল স্পষ্ট। তারা ছিলেন মুক্তি, স্বাধীনতা, সত্য, ন্যায়, সাহস ও মানবিকতার সাধক। ক্ষমতাসীন শক্তির কাছে মাথানত করেননি তারা। আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে তারা বেঁচে আছেন প্রত্যেক মানুষের বিবেকের মর্মমূলে।


বেদনার বিষয় হলো, সমাজে প্রকৃত বুদ্ধিজীবীর অভাব চরমভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। সততার সঙ্গে সত্য ও মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে ঝুঁকি নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তির দায়দায়িত্ব পালন করতে সাহস পাচ্ছেন না অনেকেই। কারণ, অতীত স্বৈরাচারের নিুমানের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বুদ্ধিজীবী সমাজকে অবক্ষয় ও পচনের সম্মুখীন করেছিল। তাদের হিম্মত ও দ্রোহ নির্বাপিত হয়েছিল। তেলবাজি ও চাটুকারিতা পুরস্কৃত হয়েছিল। সমালোচনামূলক চিন্তাগুলো সন্দেহ ও আক্রমণের শিকার হয়েছিল।


সাহস করে তখন প্রকৃত বুদ্ধিজীবীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন মুষ্টিমেয় কয়েকজন। তখন সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করা, মানবিকতার পক্ষে দাঁড়ানো, অসহায় ও নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর হওয়া, ক্ষমতার অপব্যবহার চিহ্নিত করা, জাতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সতর্কতা দেওয়ার কাজ যারা করেছিলেন, তারা কেউ ক্ষমতা, পদ-পদবির লোভে তা করেননি। তারা উজ্জীবিত হয়েছিলেন ১৯৭১-এর বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগের চৈতন্যে। তারা বিশ্বাস করতেন, সত্যের পথ কখনো পরাজিত হয় না। আশার কথা হলো, চাটুকাররা প্রভাব বিস্তার করলেও ভাঁড়েরা নানা পদে সমাসীন হলেও ইতিহাসের শেষ বিচারে প্রকৃত বুদ্ধিজীবীর সততা, সাহস ও নৈতিক অবস্থানই বিজয়ী হয়েছে। ফ্যাসিবাদের মতো চাটুকার ও তৈলবাজ শ্রেণি অন্তর্হিত হয়েছে আর টিকে আছেন প্রকৃত বুদ্ধিজীবীরা, যাদের উত্তরাধিকারে নতুন প্রজন্ম খুঁজে পাচ্ছে উত্তরণের পথ এবং আশা, ন্যায় ও মুক্তির দিশা।


বাংলাদেশ যখন ফ্যাসিবাদী অন্ধকার-অতীত থেকে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের আলোকময় প্রহরের দিকে ধাবমান, তখন প্রকৃত বুদ্ধিজীবীর দায়িত্ব অপরিসীম। তাদেরই সংকটে-সঙ্কুলতায় সাধারণ মানুষকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে হবে। যাবতীয় শাঠ্য-ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচিত করতে হবে।


এজন্যই মনে রাখা দরকার, দায়বদ্ধ বুদ্ধিজীবী আর সাধারণ বুদ্ধিজীবীর মধ্যে বিস্তর তফাত আছে। হাতের নাগালে কাগজ আর কলম থাকলেই যেমন লেখক হওয়া যায় না, তেমনিভাবে অন্যায়, অচলাবস্থা ও অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উত্থাপনের সাহস না থাকলে নিজেকে বুদ্ধিজীবী বলে নৈতিকভাবে দাবি করা যায় না। যারা সমালোচনা অত্যন্ত কঠিন ও বিপজ্জনক জেনেও সাহসের পরিচয় দিয়ে অগ্নিপরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে সত্যের পক্ষাবলম্বন করেন, তারাই প্রকৃত বুদ্ধিজীবী। প্রকৃত বুদ্ধিজীবী হলেন সত্য ও আত্মত্যাগের উত্তরাধিকার। তারা সাহসী ও সক্রিয়। সংখ্যায় সর্বদাই খুব কম। তুলনায় ভেকধারী বুদ্ধিজীবীর সংখ্যাই বেশি।


প্রকৃত বুদ্ধিজীবী যুক্তিবাদী সমাজের গোড়াপত্তনের সময় থেকেই ছিলেন, যাদের আরেকটি নাম হলো, ‘পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল’। তাদের ছিল ক্ষমতা, অন্যায় ও অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত প্রশ্ন করার ঐতিহ্য। সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল সেই ঐতিহ্যের সাহসী পথনির্মাণ করে গিয়েছেন।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও