রাজধানীর বাসাবাড়িতে বেড়েছে সাপের উপদ্রব, কেন?
ঢাকা শহরে হঠাৎই যেন অনেক বিষধর সাপের দেখা মিলছে! এক দৈনিকে প্রকাশিত খবর মতে গত তিন মাসে তিন শতাধিক সাপ উদ্ধার করেছে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন যার বেশিরভাগই আবার বহুতল ভবন বা কাচা বসতবাড়ি থেকে। অনুসন্ধানে দেখা যায় বেশিরভাগ সাপ পাওয়া যাচ্ছে নির্মাণাধীন স্থাপনা, বাড়ির নিচতলায় বা গ্যারাজে এমনকি বাসার ছাদেও!
জনবহুল শহরে বা বহুতল ভবনে সাপ দেখায় সাধারণ মানুষ অবাক হলেও আমরা যারা বন্যপ্রাণী গবেষণা বা সংরক্ষণে কাজ করি তারা কিন্তু খুব বেশি অবাক হই না। প্রতিনিয়ত আমরা পূর্বাভাস দিয়ে থাকি একটি প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা আমাদের জন্য কতবড় বিপদই না ডেকে আনতে পারে। ঢাকা শহরে হঠাৎ সাপের অধিক উপস্থিতি বুঝতে একটু পেছনে ফিরে তাকাতে হবে।
তিলোত্তমা ঢাকা শহর। এক সময়ের বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত ক্রমবর্ধমান ঢাকা শহর বিশালতা অর্জন করে এখন বিশ্বের অন্যতম জনবহুল মেগাসিটি। এই শহরের মতো বিচিত্রতা আর কোনো শহরের আছে? ২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী নিদেনপক্ষে ১ কোটি ২ লাখের ওপর মানুষের বসবাস এই জাদুর শহরে। আবার কোনো কোনো রিপোর্ট মতে এই সংখ্যা বর্তমানে ২ কোটির ওপরে।
একটি আদর্শ শহরে মোট ভূমির ১০ শতাংশের ওপরে ‘গ্রিন স্পেস’ বা সবুজ স্থান থাকা দরকার। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের এক গবেষণা বলছে, বর্তমানে ঢাকার মাত্র ২ শতাংশ এলাকায় বনভূমি রয়েছে। আর এর ৭০ শতাংশই রয়েছে মিরপুর ও এর আশপাশের এলাকায়।
যদিও বনভূমি বলতে যে বনের চিত্র আমাদের মানসপটে ভেসে উঠে তা এই শহরের আশেপাশে দেখা দুষ্কর। ২০২২ সালে প্রকাশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের এক গবেষণায় দেখা যায় রাজধানী ঢাকা শহরে টিকে আছে ২০৯ প্রজাতির বন্যপ্রাণী। এদের অনেকই আবার বিপন্ন প্রায়।
অথচ বিগত দুই তিন শতাব্দীর ঢাকার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এই নগরের আশপাশ ছিল ঘন বনজঙ্গল আর জলাভূমিতে বিস্তৃত। তৎকালীন ঢাকার সিভিল সার্জন জেমস টেলর ১৮৪০ সালে প্রকাশিত তার 'টপোগ্রাফি অব ঢাকা' গ্রন্থে বহু বন্য পশু, পাখি আর সরীসৃপের উল্লেখ করেছেন, আজ তার বেশিরভাগই হারিয়ে গেছে।
তিনি বর্ণনা করেছেন ঢাকার আশেপাশের বনে চার রকমের হরিণ পাওয়া যেত এবং এসব হরিণ নাকি তখনকার দিনে কৃষকের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করতো। আর সে আমলে জনবসতি কম থাকায় সুযোগ পেলেই অন্যান্য বন্যপ্রাণীরাও ঢুকে পড়তো শহরে। শহরে বাঘের উপদ্রব বন্ধ করতে মোঘল এবং ইংরেজ আমলে বেতন দিয়ে শিকারি রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
তার মানে মানুষ যখন থেকে নিজের প্রয়োজনে বন সাফাই করে বসতি বিস্তৃত করতে থাকলো তখন থেকে তার সাথে বন্যপ্রাণীর সংঘাত শুরু হলো। তখনকার সময়ে ঢাকার আশেপাশের এলাকা বলতে বোঝাতো মগবাজার, ধানমন্ডি, রামপুরা, তেজগাঁওসহ আশপাশের এলাকাকে।
গিরিশচন্দ্র বসু নামে এক দারগাবাবু ১৮৬৫ সালে ঢাকার অদূরে সাভারের কাছে ধলেশ্বরী নদীর পাড়ে এক কুমিরের শুয়ে থাকার স্মৃতি উল্লেখ করেন। তখনকার সময়ে এরকম দৃশ্য সহজলভ্য ছিল। যতীন্দ্রমোহন রায়ের ‘ঢাকার ইতিহাস’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে ঢাকা জেলার উত্তর ভাগ ছিল ভীষণ অরণ্য সংকুল যা ৮০ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই অরণ্যে বিচরণ করত বাঘ, হাতি, বন্য কুকুর, বুনো শূকর, কুমির, নানা রকমের সাপ, ভাল্লুক, ভোঁদড়, শিয়াল, বানর, মোষ, খরগোশ, সজারুসহ আরও বহুরকমের জীবজন্তু।
বিশাল জনগোষ্ঠীর স্থান সংকুলানের জন্য এক সময়ের জলা জঙ্গলাকীর্ণ ঢাকা হলো ফাঁকা। প্রতিনিয়ত উঠছে আকাশচুম্বী অট্টালিকা, পরিবর্তিত হচ্ছে ভূমি ব্যবস্থার। যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে ভূমি ও জল-জঙ্গলের। মাত্রাতিরিক্ত বায়ু দূষণের কারণে ঢাকার অদূরে সাভার উপজেলাকে 'ডিগ্রেডেড এয়ারশেড’ বা অবক্ষয়িত বায়ু এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে সম্প্রতি।
- ট্যাগ:
- মতামত
- সাপের উপদ্রব