
ন্যাটোর ঐক্য নিয়ে পুতিনের জুয়া খেলা
রাশিয়া ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি এখন ইউরোপের ছোট রাষ্ট্রগুলোর দিকে হাত বাড়াতে চাইছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ন্যাটোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে ঘুরপাক খাচ্ছে একটি প্রশ্ন, ন্যাটো আসলেই কতটা আন্তরিক ও কার্যকর ভূমিকা পালন করবে এ ক্ষেত্রে। সেই প্রশ্নকেই যেন নতুন করে শাণিত করলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সম্প্রতি এস্তোনিয়ার আকাশসীমায় যুদ্ধবিমান পাঠিয়ে তিনি শুধু একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বই লঙ্ঘন করেননি; বরং পুরো ন্যাটোর প্রতিশ্রুতি, ঐক্য এবং সংকল্পকে এক কঠিন পরীক্ষায় ছুড়ে দিয়েছেন।
এটি নিছক সামরিক অনুপ্রবেশ নয়—বরং এক গভীর কৌশল, যা পশ্চিমা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার শিকড়ে আঘাত হানার উদ্দেশ্যে রচিত। পুতিন জানেন, ন্যাটোর শক্তি শুধু অস্ত্রের আধুনিকতায় নয়, বরং তার ঐক্য ও পারস্পরিক আস্থায় নিহিত। আর ঠিক সেই জায়গাটিই আজ পরীক্ষার মুখে। ন্যাটো কি সত্যিই প্রতিটি সদস্যের জন্য জীবন-মরণ লড়াইয়ে নামবে, নাকি অভ্যন্তরীণ বিভেদ ও রাজনৈতিক দ্বিধা তাকে দুর্বল করে তুলবে?
এই প্রশ্ন শুধু বাল্টিক অঞ্চলের নিরাপত্তা নয়, বরং গোটা ইউরোপীয় ভূ-রাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে। কারণ, ন্যাটোর প্রতিক্রিয়া যদি দুর্বল হয়, তা বিশ্বকে জানিয়ে দেবে—আর্টিকেল ফাইভের পারস্পরিক প্রতিরক্ষার অঙ্গীকার বাস্তবে শুধুই কাগুজে প্রতিশ্রুতি। তখন ছোট রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তা ভেঙে পড়বে, আর মস্কোর প্রভাব একের পর এক সীমান্ত অতিক্রম করে বিস্তার লাভ করবে। আর যদি ন্যাটো ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়, তবে তা শুধু পুতিনকেই নয়, ভবিষ্যতের সব সম্ভাব্য আগ্রাসনকেও কঠোর বার্তা দেবে।
এস্তোনিয়ার আকাশে রুশ যুদ্ধবিমানের অনুপ্রবেশকে বিচ্ছিন্ন সামরিক ঘটনা হিসেবে দেখলে ভুল হবে। এটি এক ভূ-রাজনৈতিক দাবার চাল, যার প্রতিটি পদক্ষেপ নির্ধারণ করবে আগামী দিনের ইউরোপের নিরাপত্তাকাঠামো এবং আন্তর্জাতিক ক্ষমতার ভারসাম্য।
ন্যাটো দীর্ঘদিন ধরে ঘোষণা দিয়ে আসছে—‘জোটভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর ভূখণ্ডের প্রতিটি ইঞ্চি রক্ষায় আমরা অটল।’ এই ঘোষণা শুধু কূটনৈতিক শব্দচয়ন নয়, বরং পশ্চিমা প্রতিরক্ষাব্যবস্থার অস্তিত্ব রক্ষার মূল ভিত্তি। এর সবচেয়ে স্পষ্ট প্রতীক দাঁড়িয়ে আছে এস্তোনিয়ার তাপা সামরিক ঘাঁটিতে—যা একসময় সোভিয়েত সাম্রাজ্যের দাপটের সাক্ষ্য বহন করত, আর আজ তা ব্রিটিশ নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর প্রতিরক্ষার অন্যতম অগ্রবর্তী প্রাচীর। সেখানে ব্রিটিশ, ফরাসি ও এস্তোনিয়ান সেনারা একই পতাকার নিচে, একীভূত কমান্ড-কাঠামোয় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে; আক্রমণের মুখে তারা যেন এক শরীর, এক সংকল্প।
কিন্তু প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বাস্তবতার ব্যবধান সব সময়ই প্রশ্ন জাগায়। ন্যাটো কি শুধু ঘোষণায় দৃঢ়, নাকি প্রয়োজনে রক্ত ও আগুন দিয়ে সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে প্রস্তুত? পশ্চিমা কৌশলবিদেরা আশঙ্কা করছেন—রাশিয়া সরাসরি বৃহৎ আক্রমণে যাবে না; বরং ধীরে ধীরে, ছোট ছোট অনুপ্রবেশের মাধ্যমে ন্যাটোর প্রতিক্রিয়া যাচাই করবে। এস্তোনিয়ার আকাশসীমা লঙ্ঘন কিংবা পোল্যান্ডে রুশ ড্রোনের হঠাৎ অনুপ্রবেশ—এসব ঘটনা আসলে সেই পরীক্ষার খেলার অংশমাত্র।
রাশিয়ার কৌশল আসলে এক দীর্ঘমেয়াদি দাবার খেলা, যেখানে প্রতিটি চালের উদ্দেশ্য স্পষ্ট—ন্যাটোর ঐক্যের ভেতর ফাটল ধরানো। ন্যাটোর সনদে অন্তর্ভুক্ত আর্টিকেল ফাইভ সেই অটল প্রতিশ্রুতির প্রতীক—‘একজনের ওপর আক্রমণ মানেই সবার ওপর আক্রমণ।’ এই প্রতিশ্রুতি ঠান্ডা যুদ্ধ-উত্তর ইউরোপে শান্তির ভারসাম্য বজায় রেখেছে। কিন্তু পুতিন চাইছেন সেই অঙ্গীকারকে শুধু কাগুজে ঘোষণা হিসেবে প্রমাণ করতে।
পুতিনের কৌশল সরাসরি সর্বাত্মক সংঘাতে ঝাঁপিয়ে পড়া নয়; বরং ছোট ছোট আক্রমণ, সীমান্ত অনুপ্রবেশ বা আকাশসীমা লঙ্ঘনের মতো সূক্ষ্ম উসকানির মাধ্যমে ন্যাটোর প্রতিক্রিয়া পরীক্ষা করা। এভাবে তিনি দেখাতে চান—জোটের প্রতিক্রিয়া যদি দুর্বল বা দ্বিধাগ্রস্ত হয়, ইউরোপের ছোট রাষ্ট্রগুলো ধীরে ধীরে বিশ্বাস হারাবে সেই প্রতিশ্রুতির ওপর, আর ভয়ের আবরণে তারা হয়ে উঠবে একাকী ও অসহায়।