আমাদের দেশে সাহস করে সত্য কথা বলা লোকের খুব অভাব। বিশেষ করে সেই সত্য যদি রাজনীতি, শক্তিশালী রাজনৈতিক দল বা ক্ষমতাবান নেতা সম্পর্কে হয়, তাহলে তাদের সম্পর্কে বিরূপ কোনো কথা থাকলে পত্রপত্রিকাগুলো সাধারণত সেগুলো চেপে যায় বা এড়িয়ে চলে। মরহুম সাহিত্যিক আহমদ ছফা ছিলেন তেমন একজন ব্যক্তি। ভারতের প্রাচীনতম বাংলা দৈনিক আনন্দবাজারের মিথ্যাচার নিয়ে আহমদ ছফা যা লিখেছেন, সেটি চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। অনেক বিষয় আছে, যেগুলো সম্পর্কে কেউ মুখ খুলতে চান না। অনেকে বলেন বাবা, এগুলো খুব টাচি বা স্পর্শকাতর বিষয়। এগুলো সম্পর্কে মুখ খোলা খুব রিস্কি। তারপরও আমাদের এ সমাজে দু’চারজন ব্যক্তি আছেন যাদের আমি দুঃসাহসী বলতে চাই। সংবেদনশীল বিষয় বলতে অনেকের কাছে বোঝায় মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ নিহতের বয়ান, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত সংখ্যা, মুক্তিযুদ্ধে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা কতজন শহীদ হয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধকালে কতজন নর-নারী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, এসব শরণার্থীর মধ্যে কতজন ছিলেন হিন্দু এবং কতজন ছিলেন মুসলমান, সেই সংখ্যা; মুক্তিযুদ্ধের পর যেসব নারী বীরাঙ্গনা বলে পরিচিত হন, তাদের সঠিক সংখ্যা ইত্যাদি।
যে দু-চারজন দুঃসাহসী ব্যক্তির কথা আমার মনে পড়ছে, তাদের মধ্যে একজন হলেন অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক। গত ২৯ জুলাই দৈনিক যুগান্তর, দৈনিক মানবজমিন, দৈনিক ইত্তেফাক ও অন্য দৈনিকে তিনি যে উক্তি করেছেন, সেটিকে দুঃসাহসী বলা ছাড়া এ মুহূর্তে আর কোনো শব্দ আমার মনে আসছে না। প্রায় সব পত্রপত্রিকায় তার ওই মন্তব্যের শিরোনাম বলতে গেলে একই। শিরোনামটি হলো, ‘শেখ হাসিনা যে অপরাধ করেছে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীও তা করেনি, আসিফ নজরুল’। এ শিরোনামের সংবাদে যা বলা হয়েছে, সেটি একটু পর আমি নিচে উদ্ধৃত করছি। তার আগে আসিফ নজরুলের দুঃসাহস সম্পর্কে আরও দুটি প্রাসঙ্গিক কথা বলতে চাই।
২০২৪ সালে বইমেলায় গিয়ে একটি বইয়ের ওপর আমার নজর আটকে যায়। বইটির নাম, ‘আমি আবুবকর’। লেখক আসিফ নজরুল। বইটির মলাট তেমন চিত্তাকর্ষক নয়। তারপরও আসিফ নজরুল যেহেতু একজন বিখ্যাত ব্যক্তি, তাই আমি ওই বইটি কিনি । এরপর বাসায় এসে বইটি পড়া শুরু করতে বসে আর থামতে পারিনি। রুদ্ধশ্বাসে একটানে ১৩৪ পৃষ্ঠার এ উপন্যাসটি আমি পড়ে ফেলি।
অধ্যাপক আসিফ নজরুলের সঙ্গে আমার চাক্ষুষ কোনো পরিচয় নেই। টেলিফোনেও কোনোদিন আলাপ হয়নি। হুমায়ূন আহমেদ কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি করার পরও তার নেশা ছিল লেখালেখি এবং সিনেমা বানানো। কেমিস্ট্রি ছাপিয়ে লেখক হিসাবে তিনি শরৎচন্দ্র এবং বাংলাদেশের ‘আনোয়ারা’ উপন্যাসের লেখক নজিবুর রহমান সাহিত্যরত্নের জনপ্রিয়তাকেও ছাড়িয়ে গেছেন। নীহাররঞ্জন গুপ্ত চিকিৎসক। কিন্তু তার রহস্যোপন্যাস এবং রহস্যভেদী কিরিটি রায় চিকিৎসক নীহাররঞ্জনকে আউটশাইন করে গেছে। আমি অর্থনীতির ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও বিগত ৬০ বছর ধরে সাংবাদিকতায় আছি (অবশ্য ওদের মতো কেউকেটা আমি হইনি)। আগে একাধিক সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও গোলটেবিল বৈঠকে আমি অংশগ্রহণ করেছি, যেখানে আসিফ নজরুলও বক্তব্য রেখেছেন। তারপরও তার সঙ্গে আমার সরাসরি কোনো আলাপ হয়নি।
প্রথম আলোতে আসিফ নজরুল প্রায়ই কলাম লেখেন। প্রথম আলোতে অনেক নামজাদা ব্যক্তি কলাম লেখেন। তাদের সবার কলাম আমি পড়ি না। কারণ প্রথম আলোর একটি সুনির্দিষ্ট পলিসি আছে, যেটি অর্থনীতির পরিভাষায় প্রচ্ছন্ন বেকারত্বের (Disguised unemployment) মতো পূর্ণভাবে প্রস্ফুটিত নয়। তবে আসিফ নজরুলের কলাম আমি পড়ি। তখন মনে হয় আমরা Birds of the same feather. ভারতীয় আধিপত্য, শেখ হাসিনার Personalised Autocracy বা ব্যক্তি স্বৈরতন্ত্র, Crony Capitalism এবং kleptocracy বা চোরতন্ত্র সম্পর্কে উনি অনেক লিখেছেন।
সেজন্যই বিদেশের মাটিতে বসে কয়েকজন ইউটিউবার যখন তার সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেন, তখন আমি বিস্মিত হই। বাংলাদেশেও দু-চারজন ব্লগার বা টিভি আলোচক তার সম্পর্কে যেসব কথা বলেন, সেগুলোতে তাদের তথ্যের দৈন্যই প্রকাশ পায়।
২.
জুলাই বিপ্লবের সময় আসিফ নজরুল শুধু বিপ্লবের সারথিদেরকেই নানারকম সাহায্য সহযোগিতা করেননি, বরং সেই বিপ্লবে সুস্পষ্ট অবদান রাখার জন্য তিনি নিজেও বিপন্ন হয়েছিলেন। যারা তার সম্পর্কে তির্যক মন্তব্য করেন, তাদের আমি ‘আমি আবুবকর’ উপন্যাসটি পড়তে বলছি। শুধু পড়ার পরই তার সম্পর্কে আপনি আপনার Conclusion draw করতে পারেন, তার আগে নয়। গঙ্গার পানি বণ্টন সম্পর্কে তার লেখাগুলো পড়ুন। দেখবেন পানি নিয়েও বাংলাদেশের ওপর ভারতের দাদাগিরি সম্পর্কে একমাত্র বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ বিএম আব্বাস ছাড়া আর কেউ এত তথ্যসমৃদ্ধ লেখা লিখতে পারেননি।
এখন আমি ফিরে যাচ্ছি তার ওই দুঃসাহসিক মন্তব্যে। দৈনিক মানবজমিনে এ সম্পর্কে যে রিপোর্ট বেরিয়েছে তার পুরোটাই আমি নিচে উদ্ধৃত করছি :
‘শেখ হাসিনা ও তার দোসররা যে অপরাধ বাংলাদেশে করেছে, আমার মনে হয়, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীও এত জঘন্য অপরাধ করেনি। তিনি বলেছেন, মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলা, আহতদের গুলি করে মেরে ফেলা, নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করে মেরে ফেলা, আপনারা বলতে পারেন, ২৫ মার্চ কালরাতে হয়েছে। অবশ্যই হয়েছে, ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ওটা তো অন্য দেশের বাহিনী। আমরা তো স্বাধীনতা ঘোষণা করেছি তারপর’। গত ২৯ জুলাই, জুলাই হত্যাযজ্ঞের বিচারের ওপর আলোচনা ও তথ্যপ্রদর্শনীতে তিনি এসব কথা বলেন।