
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ‘জাদু’ ও প্রধান উপদেষ্টার ৭ দফা
মার্চ মাসে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের উপস্থিতিতে লাখো শরণার্থীর সামনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস আশাবাদ প্রকাশ করেছিলেন রোহিঙ্গারা আগামী রোজার ঈদ তাদের নিজ দেশে অর্থাৎ মিয়ানমারে পালন করবে। কিন্তু সেই মুহূর্তেই এই আশার বাস্তবতা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়। প্রশ্ন ওঠে, জাতিসংঘ বা অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে কি এমন কোনো ‘জাদু’ আছে, যা দিয়ে এক বছরের মধ্যে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ থেকে ফেরত পাঠানো সম্ভব?
গত শতাব্দীর সত্তরের দশক থেকেই রোহিঙ্গারা কমবেশি করে বাংলাদেশে এলেও সবচেয়ে বড় ঢল নামে ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট। ওই ঘটনার ৮ বছরপূর্তি উপলক্ষে সোমবার একটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম: ‘প্রত্যাবাসন অনিশ্চিত, নতুন এসেছে সোয়া লাখ রোহিঙ্গা। অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় সীমান্তের ওপারে ২৫-৩০ হাজার।’ তার মানে গত মার্চের ওই ঘোষণার পরে গত পাঁচ মাসে এবং অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। উল্টো সোয়া লাখ রোহিঙ্গা নতুন করে বাংলাদেশে ঢুকেছে।
এরকম বাস্তবতায় সোমবার রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানে কক্সবাজারে আয়োজিত ‘স্টেকহোল্ডারস’ ডায়ালগে যোগ দিয়ে সাত দফা প্রস্তাব পেশ করেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। এর মধ্যে রয়েছে রোহিঙ্গাদের দ্রুত, নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ, স্বেচ্ছামূলক ও টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য একটি কার্যকর রোডম্যাপ তৈরি করা; আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠী ও মানবিক অংশীদারদের সহায়তা অব্যাহত রাখা; আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় আসিয়ানসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তৎপরতা বাড়ানো ইত্যাদি। মুহাম্মদ ইউনূস সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি বলেছেন তা হলো, রোহিঙ্গা সংকটের সূত্রপাত মিয়ানমারে, তাই সমাধানও হতে হবে সেখানেই।
২০১৭ সালে যখন জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করল, সেই বছর থেকেই শোনা যাচ্ছে মিয়ানমার সরকার ধাপে ধাপে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে। কিন্তু যে প্রশ্নটি একজন সাধারণ মানুষের মনেও ছিল বা এখনও আছে সেটি হলো, যে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদেরকে তাদের নাগরিকই মনে করে না এবং যাদেরকে হত্যা, ধর্ষণ, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো বীভৎস নারকীয়তার মধ্য দিয়ে বাস্তুচ্যুত করেছে—তারা কেন সেই রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে?
২০১৮ সালের জানুয়ারিতে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি সই করেছিল মিয়ানমার। চুক্তি সইয়ের দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসনপ্রক্রিয়া শুরুর কথা ছিল। বাংলাদেশ ২০১৮-২০ সালে ছয় ধাপে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের তালিকাও দিয়েছিল। এরপর ২০২৩ সালে ১ হাজার ১০০ রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর জন্য একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। সেটিও সফল হয়নি। প্রতি বছর বিভিন্ন উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক, কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং চীন বা আসিয়ানভুক্ত দেশের মধ্যস্থতার আশ্বাস মিললেও কোনো রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি।
তবে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে চাইলেও সমস্যার সমাধান হয়ে যাচ্ছে না। কেননা, নাগরিকত্ব এবং জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা ছাড়া রোহিঙ্গারা কেন রাখাইনে যাবে—এটি আরেকটি বড় প্রশ্ন। তাদের শঙ্কা, সেখানে গিয়ে আবারও যদি হত্যা, ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের শিকার হতে হয়, তাহলে তারা সেখানে কেন ফিরবে? তাছাড়া জাতিগত সহিংসতা এবং গণতন্ত্রহীনতার কারণে যুগের পর যুগ ধরে মিয়ানমার যে ধরনের সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, তাতে বিশ্ব সম্প্রদায়ও এ মুহূর্তে রোহিঙ্গাদের সেখানে ফেরত পাঠানোকে নিরাপদ ও মানবিক মনে করে না।