
বৈপ্লবিক পরিবর্তন করার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেছে
ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পিএইচডি করেছেন। হামবোল্ট রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন জার্মানির পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার অসংগতি, বৈষম্য নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন তিনি। জুলাই আন্দোলন, শিক্ষক ও ছাত্ররাজনীতির গতিধারা এবং শিক্ষাব্যবস্থার নানা বিষয় নিয়ে আজকের পত্রিকার সঙ্গে।
গত বছর আন্দোলনের সময় আপনিসহ অনেক শিক্ষক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়ে। এক বছর পর গণ-অভ্যুত্থান কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
কামরুল হাসান মামুন: আমার আশাটা উল্টো পথে চলে গেছে। আমার আশা তো মেটেনি, বরং অনেক কিছুই নেতিবাচক, যা আমাকে মারাত্মকভাবে কষ্ট দেয়। জুলাই আন্দোলন যে স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা নিয়ে হয়েছিল, তার কোনো কিছুই আর প্রাপ্তির খাতায় নেই। আমি আশা করেছিলাম শিক্ষা খাত একটা বিশেষ গুরুত্ব পাবে। যেহেতু এই আন্দোলনের মূল ইঞ্জিন ছিল ছাত্র ও শিক্ষকেরা। সঙ্গে জনগণ ও বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষও ছিলেন। এই অভ্যুত্থান সফল হওয়ার ক্ষেত্রে প্রথমত শিক্ষার্থীদের বড় ভূমিকা ছিল। শিক্ষকদেরও ভূমিকা ছিল। সেই জায়গা থেকে আমি আশা করেছিলাম, শিক্ষায় একটা বিপ্লব আসবে। কারণ, আন্দোলনের প্রেক্ষাপটও শিক্ষার ইস্যু নিয়েই শুরু হয়েছিল। আমরা একটা সুযোগ হারিয়ে ফেলেছি। সেই সুযোগ হয়তো ১০, ২০, ৩০ বা ৫০ বছরে না-ও আসতে পারে। অনেকগুলো ছাত্র-জনতার মৃত্যু এবং পঙ্গুত্ববরণের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশ পাওয়ার আশা করেছিলাম, সেটা কীভাবে বিপথে চলে গেল—এটা যতবার ভাবি, ততবার সেটা নিয়ে আমার কষ্ট হয়।
গণ-অভ্যুত্থানের সুযোগগুলো কেন হারিয়ে গেল?
কামরুল হাসান মামুন: আন্দোলনের সময় সবার চাওয়া-পাওয়াগুলোতে একটা ঐকমত্য ছিল। আন্দোলনের পরপরই সবাই তাদের ব্যক্তিগত, দলীয় স্বার্থ এবং নানা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে উঠল। আবার অন্তর্বর্তী সরকার কয়েকটি ভুল শুরুতেই করেছে। এর মধ্যে দুটি ভুল মারাত্মক ছিল। এক. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণ করার আগে ভালোভাবে হোমওয়ার্ক করেননি। তিনি শিক্ষার্থী নেতৃত্বদের বলতে পারতেন, ‘এ দেশের জনগণ তোমাদের আজীবন স্মরণ রাখবে। তোমাদের দায়িত্ব পালনের জন্য তোমাদের অসংখ্য ধন্যবাদ। তোমাদের এখন নিজ কাজে ফিরে যাওয়াই উচিত হবে। তোমরা আমাদের দায়িত্ব দিয়েছ। এখন আমাদের কাজটা করতে দাও।’ এসব না করে তিনি বললেন, ‘তোমরাই আমাকে বসিয়েছ। তোমরা এই আন্দোলনকে সফল পরিণতি দিয়েছ। তোমরাই এ আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড।’ এভাবে তিনি তাদের পিঠ চাপড়ে দিলেন। এই যে তিনি তাদের আকাশে ওঠালেন, এটাই ছিল ভুল। কারণ, তারা হঠাৎ করেই সেলিব্রিটি হয়ে গেল। হঠাৎ করে কেউ যখন বড় সেলিব্রিটি হয়ে যায়, তখন সেটা কেউ কেউ ধারণ করতে পারে না। সবকিছুকে ধারণ করার জন্য পাত্র লাগে। ক্ষমতা, সুনাম পাওয়ার জন্য জ্ঞান, অভিজ্ঞতা নামক একটা পাত্র লাগে। জ্ঞান, অভিজ্ঞতার পাত্রটা যদি বড় না হয়, তাহলে সেটা উপচে পড়ে। সেই উপচে পড়ার ব্যাপারটি এখন চারদিকে দেখা যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের মঙ্গলের জন্য যদি প্রধান উপদেষ্টা সেই সময় বলতেন, ‘তোমরা নিজেদের প্রস্তুত করো। কিছুদিন পরই তোমাদেরকে এ দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হবে, তার জন্য তোমরা লেখাপড়া করে জ্ঞান অর্জন করো। নেতৃত্বের গুণাগুণ অর্জন করো।’ কিন্তু তিনি সেটা করলেন না।
গত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকার শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত পরিবর্তনে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেছে?
কামরুল হাসান মামুন: মোটেও না। এই সরকারের ভাবমূর্তি মানুষের কাছে অনেক বেড়ে যেত যদি এই বাজেটে শিক্ষায় জিডিপির ৫ এবং স্বাস্থ্য খাতে ৪ শতাংশ বরাদ্দ দিত। সারা দেশের মানুষ অবশ্যই সাধুবাদ জানাত। গণ-অভ্যুত্থানের পরে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হতে পারত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর মাধ্যমে। এ দেশের প্রত্যেক অভিভাবকের একমাত্র স্বপ্ন হলো তাঁর সন্তানের শিক্ষা। যেখানে গত সরকারের শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল জিডিপির ১.৬৯ শতাংশ আর এ সরকার দিল ১.৭১ শতাংশ। তাহলে শিক্ষায় কি কোনো পরিবর্তন হয়েছে? তারা তো ইমপ্যাক্ট তৈরি করতে পারেনি। ইমপ্যাক্ট তখনই তৈরি হতো যদি সরকার শিক্ষায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন করত। তারা যে সুযোগ হাতছাড়া করল, এটা হলো অপূরণীয় ক্ষতি।
পৃথিবীতে যত দেশ উন্নত হয়েছে, তারা শিক্ষা ও অর্থনীতিতে হাত ধরাধরি করে হেঁটেছে। আগে শিক্ষায় উন্নত হতে হয়, এটার কারণে উন্নত মানুষ তৈরি হয়, এরপর উন্নত মনের মানুষেরা দেশের উন্নতি করে। বিগত সরকার শিক্ষাকে ধ্বংস করেছে। আর অনুন্নত মানুষকে টাকা বানানোর দায়িত্ব দিয়েছিল। ফলে চুরি, বাটপারি, অপচয়গুলো হয়েছে। মানুষ তৈরি না করে যদি উন্নয়নের দিকে যাই, তাহলে হবে অপচয়।
চীনের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ২০ বছর আগেও ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিংয়ে ১০০-এর মধ্যে ছিল না। সেই চীনের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ২০-এর মধ্যে অবস্থান করছে। আশা করা যায়, আগামী ১০ বছরের মধ্যে তারা ১ থেকে ১০-এর মধ্যে চলে আসবে। এই যে চলে আসা এবং তাদের যে অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়ন, দুটিই হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে। পৃথিবীতে কোনো দেশ নেই, যারা ক্ষমতা ও অর্থনীতিতে উন্নতি করেছে শিক্ষা ছাড়া।