
বাংলাদেশে বর্তমানে পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে খুব দ্রুত। এ কারণে সব ঘটনার কার্যকারণ বোঝা মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে; বিশেষত দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন খুব বেশি অস্থির হয়ে পড়ার কারণে এখন সামনের দিনগুলোতে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা অনুমান করাও প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
গত জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের পতন ও পলায়নের পর মানুষ দেশের উন্নতি ও স্থিতিশীলতার বিষয়ে খুব আশাবাদী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এটা কি দুর্ভাগ্য না ষড়যন্ত্র, যে যখনই এদেশের সাধারণ মানুষ তাদের ভবিষ্যতের বিষয়ে আশাবাদী হয়েছে, তখনই কোনো কোনো গোষ্ঠী তাদের স্বীয় হীনস্বার্থ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে জলাঞ্জলি দিয়ে নিজেদের ভাগ্যকে গড়ার চেষ্টা করেছে? এটা দেখা গেছে ১৯৭১ সালের আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর, ১৯৯০-এর সফল গণ-অভ্যুত্থানের পর এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে ২০২৪-এর সফল গণ-অভ্যুত্থানের পরও।
বাংলাদেশের মাটিতে ইতঃপূর্বে সংঘটিত ১৯৬৯ ও ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থানের দিকে তাকালে দেখা যায়, দেশে এ পর্যন্ত সংঘটিত সবকটি গণ-অভ্যুত্থানের মূল কারণ একই-গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচনের অভাব। এবং সবকটি গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে ছিল দেশের ছাত্রসমাজ।
স্বাধীনতার পর এটা কখনোই প্রত্যাশিত ছিল না যে, আমাদের আবারও গণতন্ত্র বা জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করতে হবে। কিন্তু নব্য স্বাধীন দেশে ক্ষমতায় এসেই তৎকালীন নেতৃত্ব দেশটাকে তাদের নিজস্ব সম্পত্তি মনে করে একটি গোষ্ঠীশাসন কায়েম করলেন। তার পতনের পর ‘হাঁটি হাঁটি পা’ করে গণতন্ত্রের পথচলা শুরু হয়। কিন্তু শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের জনগণ আবার গণতন্ত্রহীনতার মুখে পড়ে। ১৯৮২ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল এরশাদ। ১৯৮২ থেকে ১৯৯০, এ দীর্ঘ সময়কালে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতাকে যখন প্রায় পাকাপোক্ত করে ফেলেছেন, তখন শহীদ নূর হোসেন ও শহীদ জিহাদের উত্তরসূরিরা এক গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সক্ষম হন। দেশে আবারও গণতন্ত্র ফিরে আসে। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা তার ক্ষমতার লোভের কারণে দেশকে আবারও অস্থিতিশীল করে ফেলেন। ১৭৬ দিনের হরতালের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি যখন ভেঙে পড়ার মুখে, তখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েও দেশের মানুষ ও অর্থনীতির কথা বিবেচনা করে জাতীয় সংসদে ‘নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য সংবিধানে ‘ত্রয়োদশ সংশোধনী’ আনেন। তিনি দেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তন করে জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে রাজপথে ফিরে যান। পরবর্তীকালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না থাকলেও শেখ হাসিনা নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসাবে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের সর্বশেষ প্রধান বিচারপতিকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানালে দেশে আবারও নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয় ২০০৬ সালে, যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৭ সালে সামরিক বাহিনীর সমর্থনে একটি অনির্বাচিত সরকার দেশের ঘাড়ে চেপে বসে।
তারপর ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত এক নীলনকশার নির্বাচনে শেখ হাসিনা আবারও ক্ষমতায় আসেন। পরিতাপের বিষয় হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দুবার বিজয়ী হওয়া সত্ত্বেও শেখ হাসিনা ‘হাইকোর্টের’ এক ফরমায়েশি রায়ের ওপর ভিত্তি করে ২০১২ সালে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার বিধানকেই সংবিধান থেকে বিলুপ্ত করে দেন। এরপর ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত জনগণের ওপর চলে নির্যাতন-নিপীড়ন, গুম-খুনের এক অবিশ্বাস্য স্বৈরাচারী শাসন। স্বভাবতই স্বাধীনতাপ্রিয় বাংলাদেশের জনগণ এ অপশাসনকে বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়নি। তারা ২০১২ থেকেই এ স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে থাকে। কিন্তু স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা ধীরে ধীরে দেশের সব প্রতিষ্ঠানকে ভেঙে চুরমার করে তার একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে দেশের মানুষের ওপর যে মাত্রায় বলপ্রয়োগ করা শুরু করে, তা ছিল এদেশের জনগণের জন্য অভাবিতপূর্ব। পুলিশসহ আওয়ামী লীগের নানা পেটোয়া বাহিনী রাতের আঁধারে দেশের রাজনৈতিক দলের কর্মী, সমর্থক ও সংগঠকদের তুলে নিয়ে নির্যাতন-নিপীড়ন তো বটেই, তাদের গুম ও খুন করে ফেলাটাকেও প্রায় প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করে ফেলেছিল।
দেশে যখন সরকারবিরোধী তুষের আগুন ধিকি ধিকি করে জ্বলছে, সে সময় ভারতের তীব্র চাপের মুখে ভারতকে ‘রেল করিডোর’ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় আওয়ামী লীগ সরকার। একইসঙ্গে দেশের দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর মোংলার পরিচালনার দায়িত্বও এক ভারতীয় কোম্পানিকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। সে কারণে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য বিলুপ্ত ‘কোটা ব্যবস্থাকে’ ফিরিয়ে আনে সরকার। এতে সারা দেশের ছাত্রসমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট এবং ছাত্রদের নেতৃত্বে ‘কোটাবিরোধী’ আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে, সারা দেশের ছাত্রদের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। সরকার তাদের প্রয়োজনমতো সময়ে আন্দোলনকে থামিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ছাত্রলীগের তৃতীয় সারির একাধিক নেতাকে সুকৌশলে ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের’ নেতৃত্বে ঢুকিয়ে দেয়। কিন্তু তাদের সব হিসাব-নিকাশ উলটে দেয় গত বছরের ১৬ জুলাই শহীদ আবু সাঈদ, ওয়াসিম আকরামসহ ছয়জন ছাত্র-যুবকের আত্মদান। সরাসরি টেলিভিশনে প্রচারিত ভিডিওতে শহীদ আবু সাঈদের এমন বীরোচিতভাবে তার দাবির পক্ষে জীবন উৎসর্গ করার দৃশ্য দেখে আর কোনো মানুষের পক্ষে ঘরে বসে থাকা সম্ভব ছিল না। এরপর সরকার তাদের নির্যাতন ও নিপীড়নের মাত্রা ভীষণভাবে বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু মানুষ যখন একবার রক্ত দিতে শিখে যায়, তখন আর কোনো নিপীড়নই কাজ করে না। এরপর অনিবার্যভাবেই চলে আসে ‘শেখ হাসিনার’ পদত্যাগের ‘এক দফার’ ঘোষণা। তখন দেশের সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা রাস্তায় নেমে আসেন। শত জুলুম-নির্যাতন করেও আর ছাত্র-জনতাকে আর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকার তার খুনি ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ সব সন্ত্রাসী, পুলিশ, বিজিবিসহ সেনাবাহিনীকেও মাঠে নামায় ছাত্র-জনতার এ ঢলকে রুখবার জন্য। কিন্তু সেনাবাহিনীর জুনিয়র কর্মকর্তাসহ সাধারণ সৈনিকরা যখন নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করতে অস্বীকার করে, তখনই শেখ হাসিনার পতন নিশ্চিত হয়ে যায়। অবশেষে আসে ৫ আগস্টের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সারা ঢাকা শহরের বাসিন্দারা রাস্তায় নেমে গণভবনের দিকে যাত্রা শুরু করে। তখন ছাত্র-জনতার রোষানল থেকে বাঁচতে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে হেলিকপ্টারে করে ভারতে পালিয়ে যান। হাসিনার পলায়নের সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশের নিগৃহীত-নিপীড়িত জনগণ স্বৈরাচারের কবল থেকে মুক্তির আনন্দে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে। সেদিন ঢাকার রাজপথে অন্যূন ৫০ লাখ মানুষ নেমে এসেছিল।
- ট্যাগ:
- মতামত
- জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস