
ওষুধের ভুল ও অযৌক্তিক ব্যবহার কতটা ভয়ানক?
ওষুধের ভুল ও অযৌক্তিক ব্যবহার কতটা ভয়ানক তা বুঝতে একটি বাস্তব ঘটনা দিয়ে শুরু করা যাক। রাজশাহীর মেহেরুন নাহার (ছদ্মনাম) নামের একজন ৫৫ বছর বয়সের গৃহিণী দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের ওষুধের সঙ্গে প্রায় তিন বছর যাবৎ প্যান্টোপ্রাজল (Pantoprazole) নামক একটি পিপিআই (প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর) ক্লাসের গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খাচ্ছিলেন।
সম্প্রতি তার প্রস্রাবের সমস্যা দেখা দেয়, শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বমি বমি ভাব তৈরি হয়। পরে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে তার interstitial nephritis বা কিডনির প্রদাহ ধরা পড়ে, যার অন্যতম কারণ দীর্ঘদিন প্যান্টোপ্রাজল ব্যবহার।
সাম্প্রতিক সময়ের বেশ কিছু উচ্চমানের গবেষণা বলছে, গ্যাস্ট্রিকের সমস্যায় ব্যবহৃত প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর (পিপিআই) শ্রেণির ওষুধগুলো কিডনির প্রদাহ ও ক্রনিক কিডনি ডিজিজ তৈরি করতে পারে। শুধু তাই নয় দীর্ঘমেয়াদে (ছয় মাসের বেশি) এ ওষুধগুলো খেলে অস্টিওপোরেসিস (Osteoporosis বা হাড় ক্ষয়), ভিটামিন বি১২ এর ঘাটতির কারণে বিভিন্ন সমস্যা (যেমন অতিরিক্ত ক্লান্তি বা দুর্বলতা বোধ করা, বমি বমি ভাব, বমি বা ডায়রিয়া, হাত ও পায়ে অসাড়তা বা কাঁপুনি, জিহ্বায় ব্যথা বা আলসার, রক্তস্বল্পতা ইত্যাদি) তৈরি করে।
গ্যাস্ট্রিকের জন্য ব্যবহৃত ওষুধগুলো একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে খাওয়া উচিত যেমন এক সপ্তাহ, দুই সপ্তাহ, চার সপ্তাহ ইত্যাদি। চিকিৎসকরা প্রেসক্রিপশনে ‘চলবে’ লেখার কারণে অনেক রোগী হয়তো ভাবছেন এগুলো খাওয়া বন্ধ করা যাবে না। অনেকে নিজে নিজে এসিডিটির সমস্যা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দীর্ঘদিন এসব ওষুধ খেয়ে যাচ্ছেন এবং জটিল সব রোগ বাধিয়ে ফেলছেন।
শুধু গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ নয়। আমাদের দেশে ভয়াবহভাবে প্রায় সব ওষুধেরই ভুল ব্যবহার ও অযৌক্তিক ব্যবহার হচ্ছে এবং এর সাথে ওষুধজনিত রোগ (drug-induced disease বা DID) তৈরি হচ্ছে। ফার্মেসিতে ফার্মাসিস্ট না থাকা ও কাউন্সিলিং প্রথা না থাকার কারণে মানুষ বুঝতে পারছে না ওষুধই সেসব রোগের কারণ।
যেমন কিছু অ্যান্টিবায়োটিক (যেমন- সিপ্রোফ্লক্সাসিন, অ্যাজিথ্রোমাইসিন ইত্যাদি) তীব্র অ্যালার্জি, র্যাশ, ডায়রিয়া তৈরি করতে পারে এবং কিডনি ও লিভারের ক্ষতি করতে পারে। অ্যান্টিবায়োটিক সঠিক ডোজে সঠিক সময় পর্যন্ত না খেলে রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয়। ব্যথানাশক ওষুধ পেটের ক্ষত, অন্ত্রে রক্তপাত, কিডনি সমস্যা তৈরি করতে পারে।
স্টেরয়েড (যেমন-ডেক্সামেথাসন, প্রেডনিসোলন) অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে ওজন, রক্তচাপ ও রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায় এবং হাড় ক্ষয়ের সম্ভাবনা থাকে। স্ট্যাটিন বা লিপিড-লওয়ারিং ড্রাগস যেমন অ্যার্টভাস্টাটিন, রসুভাসটেটিনের কারণে লিভারের সমস্যা দেখা দিতে পারে ও মাংসপেশিতে ব্যথা হতে পারে।
এরকম প্রায় সব ওষুধের হালকা থেকে বেশ জটিল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া আছে। ডাক্তার ও ফার্মাসিস্টের দায়িত্ব হলো রোগীকে এ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দেওয়া। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানলে রোগী ভয়ে ওষুধ খেতে চাইবে না এরকম ধারণা করা উচিত নয়।
যেকোনো ওষুধের ক্ষেত্রে তার ডোসেজ রেজিমেন (dosage regimen) অর্থাৎ ওষুধের ডোজ (dose) (কতটুকু খেতে হবে বা প্রয়োগ করতে হবে তার পরিমাণ), কত সময় পরপর (dose interval) এবং কতদিন পর্যন্ত রোগীকে দেওয়া হবে (duration) তা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
যেকোনো ওষুধের ডোসেজ রেজিমেন নির্ভর করে রোগের প্রকৃতি ও তীব্রতা, রোগীর বয়স, ওজন ও কিডনি/লিভারের অবস্থা, ওষুধের হাফ-লাইফ বা অর্ধ-জীবন, থেরাপিউটিক ইনডেক্স (Therapeutic index), ওষুধের ফার্মাকোকিনেটিক (Pharmacokinetics) ও ফার্মাকোডাইনামিক বৈশিষ্ট্য ইত্যাদির ওপর।