অপরাধবিজ্ঞান (Criminology) হলো একটি সমাজবিজ্ঞান-ভিত্তিক শাস্ত্র যা অপরাধ, অপরাধীর আচরণ, সমাজের প্রতিক্রিয়া এবং শাস্তির কার্যকারিতা বিশ্লেষণ করে। এই শাস্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে ‘শৃঙ্খলা’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, যা ব্যক্তিগত, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে।
Social Control Theory (Travis Hirschi, 1969), এই তত্ত্বে বলা হয়, ব্যক্তির সামাজিক বন্ধন যত দৃঢ়, তার অপরাধের প্রবণতা তত কম। পরিবার, বিদ্যালয় ধর্ম ও সমাজের সঙ্গে যুক্ত থাকাই শৃঙ্খলা বজায় রাখে। যখন এই সামাজিক বন্ধন দুর্বল হয়, তখনই অপরাধের সম্ভাবনা বাড়ে।
Routine Activity Theory (Cohen & Felson, 1979), এই তত্ত্বে বলা হয়েছে, অপরাধ সংঘটিত হয় তিনটি শর্তে—একজন অপরাধপ্রবণ ব্যক্তি, একটি আকর্ষণীয় লক্ষ্য এবং অপর্যাপ্ত তদারকি। শৃঙ্খলা এখানে নজরদারির উপাদান হিসেবে কাজ করে এবং অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সুযোগ হ্রাস করে।
Broken Windows Theory (Wilson & Kelling, 1982), এই তত্ত্ব বলে, যদি ছোটখাটো বিশৃঙ্খলা (যেমন রাস্তার ময়লা, কাচ ভাঙা, গ্রাফিতি) উপেক্ষা করা হয়, তাহলে বড় অপরাধের দিকে ধাবিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এটি বোঝায়, শৃঙ্খলা বজায় রাখা অপরাধ প্রতিরোধের মূল চাবিকাঠি।
পারিবারিক শৃঙ্খলার অভাব শিশুদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ গঠনে পরিবারের ভূমিকা অপরিসীম। শৃঙ্খলাহীন পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশুদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা অনেক বেশি।
বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শৃঙ্খলার অভাবের কারণে শিক্ষার্থীরা ঝুঁকিপূর্ণ কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে, যা ভবিষ্যতে অপরাধে পরিণত হতে পারে। যদি পুলিশ, আদালত বা প্রশাসনের মধ্যে শৃঙ্খলা না থাকে, তাহলে অপরাধী শাস্তির ভয় না পেয়ে আরও উৎসাহিত হয়।
অপরাধবিজ্ঞান বিভিন্ন তত্ত্ব ও গবেষণার মাধ্যমে শৃঙ্খলা রক্ষায় কার্যকর নীতি তৈরিতে সাহায্য করে। অপরাধবিজ্ঞানের গবেষণা জনগণের মধ্যে অপরাধ ও শৃঙ্খলার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করে। কোনো এলাকায় অপরাধ বাড়লে অপরাধবিজ্ঞান তা বিশ্লেষণ করে প্রতিকারমূলক শৃঙ্খলাভিত্তিক ব্যবস্থা গ্রহণে সহায়তা করে।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে কিশোর গ্যাং, সাইবার অপরাধ, ছিনতাই, মব, মাদক ইত্যাদির বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়, যার পেছনে অন্যতম কারণ শৃঙ্খলার অভাব। পরিবার, সমাজ ও প্রশাসনিক স্তরে শৃঙ্খলার চর্চা কমে যাওয়ায় যুব সমাজ সহজেই অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। অপরাধবিজ্ঞান অনুসারে, নিয়মিত তদারকি, নৈতিক শিক্ষা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দক্ষতা বৃদ্ধি অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে।
Hirschi, T. (1969). Causes of Delinquency. Berkeley: University of California Press অনুযায়ী, যদি একজন কিশোরের পারিবারিক বন্ধন যেমন সংযুক্তি (attachment), প্রতিশ্রুতি (commitment), অংশগ্রহণ (involvement) এবং বিশ্বাস (belief) দুর্বল হয়, তাহলে তার শৃঙ্খলাভঙ্গ এবং অপরাধপ্রবণতা বাড়ে।
Dupper, D. R. (2010). A New Model of School Discipline: Engaging Students and Preventing Behavior Problems. Oxford University Press-এর গবেষণায় দেখা গেছে, স্কুলে শৃঙ্খলার অভাব সাধারণত শিক্ষক-শিক্ষার্থীর দুর্বল সম্পর্ক, অপ্রাসঙ্গিক ও শাস্তিমূলক শৃঙ্খলা নীতি এবং প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে ঘটে।