
মাছি কি ক্ষতিকর?
গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে বাংলাদেশে মাছির উপদ্রব বেড়ে যায়। এই সময় সুগন্ধিযুক্ত ও মিষ্টি রসালো ফল পাকে, যা মাছিদের আকর্ষণ করে। মাছি শুধু বিরক্তিকরই নয়, এটি বিভিন্ন রোগের বাহকও বটে। মাছি Diptera বর্গের অন্তর্গত একদল পতঙ্গ, যাদের মধ্যে Brachycera উপবর্গের সদস্যরা প্রকৃত মাছি হিসেবে পরিচিত।
এদের মধ্যে রয়েছে ঘরের মাছি (House fly), ডাঁশ, ফলের মাছি (Fruitfly), সেটসি মাছি (Tsetsefly) ইত্যাদি। মাছিদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো একজোড়া ডানা এবং পেছনের ডানাজোড়া রূপান্তরিত হয়ে ভারসাম্য রক্ষাকারী হলটেয়ারে পরিণত হয়েছে।
বিশ্বে মাছির প্রজাতি ও রোগবাহী ভূমিকা
Diptera বর্গে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার মাছির প্রজাতি রয়েছে, যার মধ্যে শুধু Brachycera উপবর্গেই ৮০,০০০-এর বেশি প্রজাতি শনাক্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে ঘরের মাছি (Musca domestica) এবং ফলের মাছি (Tephritidae পরিবার) কৃষি ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর। ঘরের মাছি কলেরা, টাইফয়েড ও ডায়রিয়ার মতো রোগ ছড়ায়, অন্যদিকে ফলের মাছি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে।
মাছির জীবনচক্র
মাছির জীবনচক্র একটি সম্পূর্ণ রূপান্তর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চারটি সুনির্দিষ্ট ধাপে সম্পন্ন হয়। প্রথম ধাপে স্ত্রী মাছি পচনশীল জৈব পদার্থ যেমন পচা খাবার, আবর্জনা, গোবর বা মৃত প্রাণীর দেহে ৭৫-১৫০টি ডিম পাড়ে। এই ডিমগুলো সাদা ও ডিম্বাকৃতির হয়, যা অনুকূল পরিবেশে মাত্র ৮-২৪ ঘণ্টার মধ্যে ফুটে শূককীট (Larva) বের করে।
দ্বিতীয় ধাপে শূককীট বা লার্ভা পর্যায়ে এরা দ্রুত বর্ধনশীল হয়। শূককীটগুলো ক্রিমি সাদা রঙের এবং পচা জৈব পদার্থ খেয়ে ৩-৫ দিনে তিনবার খোলস পরিবর্তন করে।
তৃতীয় ধাপে শূককীট শুকনো ও নিরাপদ স্থানে গিয়ে পিউপা (Pupae) বা গুটিকায় পরিণত হয়। এই পিউপা পর্যায়ে বাদামি রঙের কঠিন আবরণ গঠিত হয়, যেখানে অভ্যন্তরীণ জটিল রূপান্তর প্রক্রিয়া চলতে থাকে।
চতুর্থ ও চূড়ান্ত ধাপে ৩-৬ দিনের মধ্যে পিউপা থেকে পূর্ণাঙ্গ মাছি বের হয়ে আসে। প্রাপ্তবয়স্ক মাছি ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই প্রজননক্ষম হয়ে ওঠে, পুরুষ মাছি স্ত্রী মাছির সাথে মিলিত হয় এবং ডিম পারে। এভাবেই তাদের জীবনচক্র পুনরায় শুরু করে।
উষ্ণ ও আর্দ্র পরিবেশে এই সম্পূর্ণ চক্র মাত্র ৭-১০ দিনে শেষ হয় বলে মাছির সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পায়। একটি স্ত্রী মাছি তার ১৫-৩০ দিনের জীবনকালে ৫০০-৯০০টি ডিম পাড়তে সক্ষম, যা তাদের দ্রুত বংশবিস্তারের প্রধান কারণ। মাছির প্রজাতি ও ঋতু ভেদে এই জীবনচক্র কমবেশি হতে পারে।
বাংলাদেশে মাছির প্রজাতি
বাংলাদেশে নানাবিধ মাছির প্রজাতি দেখা যায়, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ঘরের মাছি (Musca domestica), ছোট মাছি (Fannia canicularis), দংশনকারী মাছি (Stomoxys), নীলমাছি বা ব্লোফ্লাই (Calliphora species), গ্রিনবটল ফ্লাই (Lucilia species) এবং ফ্লেশফ্লাই (Sarcophaga species)।
এছাড়া কালো মাছি (Black fly), ডিয়ার ফ্লাই (Deer fly), ঘোড়ামাছি (Horse fly), হোবারমাছি (Hover fly), ক্রেন ফ্লাই (Crane fly) এবং বেলেমাছি (Sand fly) এর মতো প্রজাতিগুলো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যায়।
মাছির প্রভাব ও ভূমিকা
মাছি সাধারণত ক্ষতিকর প্রাণী হিসেবে পরিচিত। ঘরের মাছি কলেরা ও টাইফয়েডের মতো মারাত্মক রোগ ছড়ায়, অন্যদিকে ফলের মাছি ফল ও শাকসবজির ব্যাপক ক্ষতি করে। তবে সব মাছি ক্ষতিকর নয়। কিছু প্রজাতি পরজীবী কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে এবং ফুলের পরাগায়ণে সহায়তা করে, যা পরিবেশের জন্য উপকারী।