
জনগণের চাওয়া-পাওয়ার খতিয়ান
বাংলাদেশে এ বছরের বাজেট মৌসুম শেষ হয়েছে এবং সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উত্তেজনাও বেশ কিছুটা থিতিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের ২০২৫-২৬ সালের বার্ষিক বাজেট পেশ করা হয়েছিল প্রায় দুই সপ্তাহ আগে। তারপর চিরায়ত নিয়মে নানান দৃষ্টিকোণ থেকে বাজেটের চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়েছে। সেই আলোচনায় অংশ নিয়েছে সংবাদমাধ্যম, অর্থনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষক, শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নানান গোষ্ঠী। নানান জন বাজেটের নানান দিক দেখেছেন। কেউ কেউ দেখেছেন এর আঙ্কিক দিক—এই যেমন আয়-ব্যয়ের হিসাব, কেউ কেউ দেখেছেন বাজেটের নীতিমালার দিকটি। তবে প্রত্যেকেই দেখেছেন, বাজেটে তাঁর জন্য কী আছে আর কী নেই। কোনো বছরের বাজেটই সবাইকে খুশি করতে পারে না। এ বছরের বাজেটও তার ব্যত্যয় নয়। কোনো কোনো মহল বাজেটকে অভিনন্দন জানিয়েছে, কেউ কেউ এর নানান খুঁত ধরছেন। বাজেটে কারও কারও প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে, কেউ কেউ নানান ব্যাপারে হতাশা প্রকাশ করেছেন। তবে লক্ষণীয় যে, এ বছর নানান সংবাদমাধ্যমে বাজেট বিষয়ে সাধারণ মানুষের অভিমত খুব একটা দেখা যায়নি।
সেখান থেকেই শুরু করা যাক। এ বছরের বাজেট বিষয়ে সাধারণ মানুষের নির্লিপ্ততা না হলেও একটা ঔদাসীন্য কেন দেখা গেল? অথচ মূল্যস্ফীতি, কর্মহীনতা, উৎপাদন শ্লথতার কারণে জনগণের কণ্ঠ সোচ্চার হওয়ারই তো কথা ছিল; তা তো হয়নি! তাহলে মানুষের কি কোনো প্রত্যাশাই ছিল না এ বছরের বাজেটের কাছে, নাকি তারা প্রাক্-বাজেট সময়েই হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল? এ প্রশ্নের উত্তর তিনটি আঙ্গিক থেকে দেওয়া যেতে পারে।
প্রথমত, জনগণ এ ব্যাপারে সচেতন ছিল যে, বাংলাদেশের ২০২৫-২৬ বাজেট একটি অন্তর্বর্তী সরকার দিয়েছে। একটি নির্বাচিত সরকারের বার্ষিক বাজেট সরকারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, সেই সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার (যেমন পাঁচসালা পরিকল্পনা) মধ্যে প্রোথিত থাকে। সুতরাং সেই বাজেট একটি দীর্ঘ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কাজ করে এবং তার লক্ষ্যসমূহ দীর্ঘমেয়াদি সেই পরিকল্পনা থেকেই উদ্ভূত হয়। কিন্তু একটি অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেটের ক্ষেত্রে এই প্রেক্ষিত এবং প্রক্রিয়া—কোনোটাই প্রাসঙ্গিক ও প্রযোজ্য নয়। অতএব, স্বাভাবিক কারণেই জনগণ এই বাজেটের কাছে কোনো দিগ্দর্শন প্রত্যাশা করেনি। তারা জানে যে এই বাজেট আয়-ব্যয়ের একটি বার্ষিক হিসাবপত্র মাত্র, এখানে তাদের চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। এ বছরের বাজেটের প্রতি জনগণের ঔদাসীন্যের এটি একটি অন্যতম কারণ।
দ্বিতীয়ত, মূল্যস্ফীতি রোধ, কর্মনিয়োজন বৃদ্ধি ইত্যাদি ব্যাপারে এ পর্যন্ত তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য অর্জন জনগণের চোখে পড়েনি। উপরন্তু এই বাজেটেও মূল্যস্ফীতি কমানো, কর্মনিয়োজন, প্রবৃদ্ধির প্রসারণ ইত্যাদি বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদির অনুপস্থিতি লোকের দৃষ্টি এড়ায়নি। ফলে জনমনে একটা হতাশাবোধ কাজ করেছে, যেসব বিষয় তাদের নিত্যকার জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, বাজেটে সেগুলোর যথাযথ প্রতিফলন নেই। বাজেটের প্রতি সাধারণ মানুষের নির্লিপ্ততার এটাও একটি কারণ।
তৃতীয়ত, জনমানসে এ ধারণাও কাজ করেছে যে, এ বছরের বাজেট সামষ্টিক বিষয়ে যতটা উদ্গ্রীব, ব্যষ্টিক বিষয়ে ততটা নয়—বড় বিষয়ে যতটা, ছোট বিষয়ে ততটা নয়। তাই বড় বিনিয়োগ, বৃহৎ শিল্প বাজেটে যতটা এসেছে, ক্ষুদ্র শিল্প বা বিনিয়োগ সেখানে আসেনি। ফলে বাজেট বিষয়ে বৃহৎ উদ্যোক্তাদের মতামত যতটা শোনা গেছে, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কণ্ঠ সেখানে শোনা যায়নি।
বাজেট বিষয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়েছে, তাঁদের অপ্রাপ্তির জায়গা পাঁচটি। এক, একটি বাজেট দিগ্দর্শনমূলক না হতে পারে, কিন্তু সব বাজেটেরই একটি উন্নয়নদর্শন মানুষ প্রত্যাশা করে।
সেই দর্শনই বাজেটটির সব কার্যকর ব্যবস্থাকে চালিত করে। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটটির উন্নয়নদর্শন পরিষ্কার নয়। তাঁরা ধরতে পারেননি যে বাজেটটির উন্নয়নদর্শন কি প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক, নাকি মানব ন্নয়নকেন্দ্রিক।
দুই, মানব উন্নয়ন বিষয়ে বাজেটের উন্নয়ন বরাদ্দ মানুষকে উদ্দীপ্ত করতে পারেনি। যেমন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে যে উন্নয়ন বরাদ্দ করা হয়েছে, তা শুধু অপর্যাপ্তই নয়, মোট উন্নয়ন ব্যয়েরও নগণ্য একটি অংশ মাত্র। অধিকন্তু, প্রাথমিক শিক্ষায় বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে উন্নয়ন বরাদ্দ সবচেয়ে বেশি—মোট উন্নয়ন বরাদ্দের ২৬ শতাংশ। একটি বড় হতাশার জায়গা হচ্ছে, বাজেটে কৃষি খাত আগের মতোই উপেক্ষিত থেকে গেছে—মোট উন্নয়ন বাজেটের ৫ শতাংশের কম বরাদ্দ হয়েছে কৃষি খাতে। অথচ কৃষি খাত বাংলাদেশ অর্থনীতির কর্মনিয়োজনের ৪৪ শতাংশ নিশ্চিত করে। কৃষিকে উপেক্ষা করলে সাধারণ মানুষের খাদ্য-পুষ্টি নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। সব মিলিয়ে এবারের বাজেটটি মানব উন্নয়নকেন্দ্রিক, সে সম্পর্কে জনগণ নিশ্চিত নয়।