কদিন পরপর শুনতে পাওয়া যায়, কারও অ্যাকাউন্ট হ্যাকড হয়ে গেছে, কারও গুরুত্বপূর্ণ ডেটা চুরি হয়ে গেছে, কারও একান্ত ব্যক্তিগত ছবি, ভিডিও ও কথোপকথন ছড়িয়ে পড়েছে। এমনও না যে একেবারে লেখাপড়া না-জানা মানুষদেরই শুধু এসব সমস্যা হচ্ছে। বরং উচ্চ ডিগ্রিধারী শিক্ষিত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও এটি হরহামেশাই হচ্ছে। কেউ কেউ এই ভেবে বিব্রত বোধ করেন যে এত লেখাপড়া জানার পরও কীভাবে সাইবার অপরাধীরা এতটা বোকা বানিয়ে ছাড়ল।
আমাদের প্রচলিত শিক্ষায় কখনো কি সাইবার নিরাপত্তার পাঠ গ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়? আমাদের কোর্সে, কারিকুলামে কোথাও কি সাইবার নিরাপত্তাবিষয়ক কোনো অধ্যায় ছিল? যদি সে শিক্ষাটা নেওয়ার সুযোগ না থাকে, তাহলে অপরাধীরা আমাদের বোকা তো বানানোরই কথা। সারা রাত ঘরের দরজা খোলা রেখে সকালে ঘুম থেকে উঠে অবাক হয়ে তো বলতে পারা যায় না, কীভাবে সবাইকে বোকা বানিয়ে চোর চুরি করে নিল। ডিজিটাল পরিমণ্ডল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সাইবার নিরাপত্তা—এসব বিষয় এখন এমন একপর্যায়ে পৌঁছে গেছে, প্রাতিষ্ঠানিক সব শিক্ষা থাকার পরও উপযুক্ত পাঠ বা প্রশিক্ষণ না গ্রহণ করলে একজন মানুষ এসব বিষয়ে নিরক্ষরই থাকবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে এখন আর বিশেষ শিক্ষা হিসেবে ভাবার সুযোগ নেই। এ বিষয়ে এখন সব স্তরের, সব শাখার শিক্ষার্থীদের জানা প্রয়োজন। মাইক্রোসফট ওয়ার্ড, পাওয়ার পয়েন্ট বা সমজাতীয় সফটওয়্যারগুলোয় যেমন সব শিক্ষার্থীর দক্ষতা থাকা উচিত, তেমনি থাকা উচিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিতের দক্ষতা। এসব বিষয় আমাদের জীবনকে এতটা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছে যে নিজের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য এটি যেমন জরুরি, সঙ্গে সঙ্গে তা জরুরি পরিবার, সমাজ এমনকি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্যও।
যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে এআই এডুকেশন অ্যাক্ট নিয়ে এসেছে। এর উদ্দেশ্য দেশব্যাপী শ্রেণিকক্ষে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শিক্ষা চালু করা, সাধারণের জন্য সহজলভ্য ও সহজবোধ্য বই তৈরি। সেখানে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে গ্রামীণ ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের প্রতি। রাখা হয়েছে শিক্ষকদের এআই জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য আকর্ষণীয় সুযোগ, যাতে তাঁরা শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারে উদ্যোগ নিতে পারেন।
চীন ইতিমধ্যেই তাদের বেশ কিছু প্রদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠ্যক্রমে এআই সংযুক্ত করেছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) ডিজিটাল শিক্ষা কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে এআই সাক্ষরতা উন্নত করা এবং শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর জোর দিয়েছে। সিঙ্গাপুর নিয়ে এসেছে ‘সবার জন্য AI (AI4 E)’ এবং ‘শিক্ষার্থীদের জন্য AI (AI4 S)’। এসব উদ্যোগের মাধ্যমে নাগরিক ও শিক্ষার্থীদের জন্য বিনা মূল্যে আয়োজন করা হয় নানা রকম কর্মশালার।
ওদিকে সাইবার নিরাপত্তাবিষয়ক শিক্ষা বাড়াতে মার্কিন সরকার তৈরি করেছে ‘ন্যাশনাল ইনিশিয়েটিভ ফর সাইবার সিকিউরিটি এডুকেশন’ কাঠামো, যেটি শিক্ষার প্রায় সব পর্যায়ে সাইবার সিকিউরিটি শিক্ষাকে সম্পৃক্ত করে। ইইউর আছে সাইবার সিকিউরিটি স্কিলস একাডেমি উদ্যোগ, যেটি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় সাইবার সিকিউরিটিকে অন্তর্ভুক্ত করা, শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা এবং জনবলের ঘাটতি পূরণের জন্য গোটা ইইউব্যাপী নেওয়া এক প্রচেষ্টা। যুক্তরাজ্য তৈরি করেছে সাইবার স্কুল হাব, যেটির মাধ্যমে বিভিন্ন কর্মশালা ও শিক্ষাদানের জন্য মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে পেশাদারদের সম্পৃক্ত করা হয়।
স্কুল-কলেজ পর্যায়ে এসব উদ্যোগ তো দূরে থাক, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি বিশাল অংশ জানে না, ব্যক্তিগত উপাত্ত হারিয়ে গেলে কী ধরনের সমস্যা হয়। কেন উপাত্ত সুরক্ষা প্রয়োজন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কীভাবে পক্ষপাতদুষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে পারে, কীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে অনৈতিক আচরণ করা যায়—এসব আমাদের অনেকের কাছেই স্পষ্ট নয়।