জাতি হিসেবে আমরা অনেক বিষয়েই উদাসীন। এর মধ্যে শিশুদের প্রতি আমাদের জাতিগত ঔদাসীন্য ও অবহেলা খুবই উদ্বেগজনক। তারাই যে দেশের ভবিষ্যৎ, সে কথা সবাই জানি এবং অহরহ বলে আসছি। কিন্তু সমাজের বয়স্কদের দিকে তাকালে আমরা কি বলতে পারব, তাঁদের শৈশবের বিকাশপর্ব ঠিকভাবে অতিবাহিত হয়েছিল?
আমরা দেখি, সত্য গোপন শুধু নয়, সামান্য সুবিধার জন্যও অবলীলায় মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া মোটেও ব্যতিক্রমী ঘটনা নয় এ সমাজে। সহজেই মানুষ ছোট-বড় দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে, স্বজনের উপকারে পক্ষপাতদুষ্ট কাজে সোৎসাহে সক্রিয় হতে দেখা যায়। ক্ষমতার দাপটে এখানে অহরহ নিয়ম ভেঙে পড়ে, আইন থমকে যায়।
মানুষের মধ্যে স্বার্থপরতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। যেন আদিকালের শিকারিজীবনের চাপা পড়া হনন–প্রবৃত্তির নিয়ন্ত্রণ টুটে গিয়ে বহু মানুষ এখন হিংসায় উন্মত্ত এবং একমাত্র জিঘাংসাতেই সংঘাতের মীমাংসা খুঁজছে। মানুষের ভোগবাসনার দাপট দেখে বোঝা যায়, শৈশবে তাদের সুকুমারবৃত্তি ও সংবেদনশীলতার জমিন ঠিকভাবে কর্ষিত হয়নি।
অভিভাবকেরা সন্তানদের শৈশবকে ফলাফলের ইঁদুরদৌড়ে এতটাই ব্যস্ত রেখেছিলেন যে বড় হয়ে তারা নিজেদের সুপ্ত ক্ষমতা ও প্রতিভার উন্মেষ ঘটাতে পারেনি। ফলে শিশুর সুষ্ঠু বিকাশে যত্নের যে অভাব ঘটছে, সেই বাস্তবতা কেবল বঞ্চনা নয়, শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা।
পুরুষশাসিত এ সমাজে পুরুষের মানবিক অক্ষমতার করুণ বাস্তবতা প্রায়ই ঘটে থাকে নারী ও শিশুর প্রতি কদর্য নিষ্ঠুরতায়। শিশুর পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যার মতো নির্মমতা ভাবা যায়! এমন সমাজে শিশু ও নারী উভয়েই নানা অনাচার-অবিচারের ভুক্তভোগী। বুঝতে হবে যে কেবল কঠোর আইন আর কঠিন শাস্তিতে এই সামাজিক ব্যাধির সমাধান হবে না।
একসময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগে খণ্ডকালীন পড়াতে যেতাম। বিভিন্ন ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের জিজ্ঞাসা করতাম, তাদের মধ্যে কতজনের মাঠে গিয়ে খেলার অভিজ্ঞতা আছে। দেখা যেত, কি ছেলে কি মেয়ে—সিংহভাগ শিক্ষার্থীই জীবনে কখনো মাঠে গিয়ে খেলেনি। অধিকাংশ শিক্ষার্থী স্কুলজীবনে পিকনিকে যাওয়ার সুযোগ পায়নি, বার্ষিকী প্রকাশ হতে দেখেনি, নাটকে অংশ নেয়নি, পাঠাগার থেকে বই পড়েনি (অনেক স্কুলে পাঠাগার ছিলই না)।
এভাবে নানা ‘না’–এর সমাহার অর্থাৎ বহুতর বঞ্চনার (এবং অবহেলার) তালিকা আরও দীর্ঘ করা যাবে। এসব বঞ্চনার ভেতর দিয়ে বড় হওয়া তরুণেরা ছেলে-ছেলে বা মেয়ে-ছেলে কিংবা মেয়ে-মেয়ে পরস্পর কেজো বা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলার স্বাভাবিক ক্ষমতার অভাব বেশ প্রকট। আবেগের বশবর্তী এমন সম্পর্ক যেমন দ্রুত গড়ে ওঠে, তেমনি ভাঙেও তাড়াতাড়ি। সবচেয়ে বড় কথা, তাদের তারুণ্যের (অর্থাৎ যৌবনের) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্ব কেটে যায় জীবনের বৈচিত্র্যপূর্ণ বিভিন্ন অঙ্গের পাঠ, রস গ্রহণ ছাড়া গতানুগতিক চক্রের আবর্তে। এতে তাদের রাজনীতি, আড্ডা বা বেশির ভাগ কাজের পরিণতি খুব উচ্চ মানবিক প্রাপ্তি দিতে পারে না। অপ্রাপ্তি, অতৃপ্তি নিয়ে সহজে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়িয়ে যায়।
একালে শিক্ষার্থীদের, বস্তুত অধিকাংশ মানুষের একটা বড় অংশের জীবনে ভোজনই প্রধান বিনোদন। তাই তো শহরে শহরে নতুন নতুন রেস্তোরাঁর কমতি নেই। বাহারি পোশাকের আকর্ষণও কম নয়। এ দুইয়ের ডিজিটাল আকর্ষণেরও শেষ নেই। সব মিলে ডিজিটাল ডিভাইসের আসক্তি সংক্রামক রোগের মতো ছড়াচ্ছে। একালে শিশুসহ সাধারণভাবে মানুষমাত্রই অন্দরের (ইনডোর) প্রাণীতে পরিণত হচ্ছে, প্রকৃতির সঙ্গে স্বাভাবিক নৈমিত্তিক সম্পর্ক হয় না বললেই চলে।
পরীক্ষা ও মুখস্থনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা এবং সামাজিক নানা কারণে গৃহবন্দিজীবনে শিশুর সহজাত কৌতূহল, জিজ্ঞাসা, কল্পনাপ্রবণতা, বিস্ময়বোধ ইত্যাদি জীবনপ্রভাতেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অল্প কিছু দারুণ মেধাবী, অদম্য মনোবলের অধিকারী কিংবা যথার্থ পারিবারিক সহায়তাপ্রাপ্ত শিশু-কিশোর-তরুণের সাফল্যকে দৃষ্টান্ত ধরা যাবে না, সেটা ব্যতিক্রম। আমাদের সামাজিক তলরেখা অস্বাভাবিক নিচে চলে গেছে। অবস্থা নিরাময়ের বাইরে চলে যাওয়ার আগে এ নিয়ে ভাবা জরুরি।