
প্রশান্তদের পোড়াবাড়ি এবং অগ্নিদগ্ধ-রক্তস্নাত মাটি
শুধু যেন ক্ষতের ওপর ক্ষত। ফের সেই ক্ষত দগদগে ঘা হয়ে প্রকাশ পেল প্রশান্ত হালদারদের পোড়াবাড়িতে। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার রাখালগাছি ইউনিয়নের রঘুনাথপুরে প্রশান্ত হালদারের পৈতৃক ভিটেমাটি। মঞ্চাভিনেতা, কথাশিল্পী, নাট্যকার প্রশান্ত হালদারের বাড়িটি কোনো দুর্ঘটনায় পুড়ে গেলো নাকি পুড়িয়ে দেওয়া হলো? সংবাদমাধ্য়মের সূত্র ধরে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। রক্তস্নাত এ দেশের বহু পুরানো মর্মস্পর্শী খেলার নাম 'উচ্ছেদ-উচ্ছেদ খেলা’। আর কেউ উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া মানেই অন্য কারোর দখলবাজি।
প্রশান্ত হালদারদের যৌথ পরিবারটি কি এই মর্মস্পর্শিতারই শিকার? যতটুকু জেনেছি রঘুনাথপুর গ্রামে এই একটি মাত্র হিন্দু পরিবার এখনও টিকে আছে, যাদের যথেষ্ট জোতজমি আছে। সহজ প্রশ্ন কারা এই পরিবারটিকে রাখালগাছি থেকে বিতাড়িত করতে চায়? এমন প্রশ্ন আছে অনেক, যেন প্রশ্নের পাহাড় কিন্তু নেই কোনো সদুত্তর!
দায়িত্বশীলদের ফের উচ্চারণ এর যথাযথ বিহিত হবে; অপরাধী কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। এমন অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি ভুক্তভোগীরা শুধু শুনেই আসছেন কিন্তু কয়জন প্রতিকার-প্রতিবিধানের আলো দেখেছেন? প্রশ্নটির উত্তর প্রীতিকর নয়।
প্রশান্ত হালদারদের তালিকা অনেক দীর্ঘ। ৫৪ বছরের এই বাংলাদেশে অনেক প্রশান্ত হালদারের স্বপ্নের পাঁজর ভেঙেছে, অনেক শেফালী, অনেক পূর্ণিমার সম্ভ্রম গেছে; প্রতিবিধান মিলেনি বহু ক্ষেত্রেই। পূর্ণিমার মতো যারা টিকে আছেন, তারা নিজের মনের জোরেই আছেন। শেফালীর কথা মনে আছে আপনাদের? ভোলার লর্ডহার্ডিঞ্জের পঙ্গু শেফালী ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ২০০১ সালের নির্বাচনের পরদিন। শেফালী এখন ভারতে তিস্তা চরের গজলডোবায়। শাশুড়ি-পুত্রবধূ সুজাতা আর বিষ্ণুপ্রিয়াও লর্ডহার্ডিঞ্জে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন একই রাতে। তারাও আর বাংলাদেশে নেই। এমন না থাকার গল্প অনেক এবং গল্পটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।
রাজনীতি ও ভোটের সমীকরণে অনেক অপরাধ চিহ্ন মুছে গেছে। ২২ মে দিবাগত রাতে রঘুনাথপুরে ঘটে যাওয়া ঘটনায় থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন প্রশান্ত হালদার। তিনি ঢাকার নাট্যদল 'অনুস্বর'-এর প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। প্রায় চার দশক ধরে তিনি নাট্যচর্চায় যুক্ত। নাট্যকার ও অভিনেতা হিসেবেও তার যথেষ্ট পরিচিতি আছে। তার বোন বোন শ্রাবণী রাখী এবং শ্রাবণীর স্বামী মনোজ দে সাংবাদিকতা করেন।
ফলে তাদের বাড়িতে আগুনের ঘটনায় প্রতিবাদ হচ্ছে। আরও সব প্রশান্তদের খবর আমরা কতটা রেখেছি। প্রশান্ত হালদারের বাড়িতে হামলায় প্রতিবাদ জানিয়েছে নাট্যদল 'অনুস্বর' এবং থিয়েটার বিষয়ক পত্রিকা ‘ক্ষ্যাপা’। কিন্তু আইনি প্রতিবিধানের বিষয়টি নিশ্চিত করার দায়-দায়িত্ব যাদের তারা কি দৃষ্টান্তযোগ্য নজির স্থাপন করতে পারবেন? এমন জিজ্ঞাসা-প্রত্যাশার সদুত্তরের অপেক্ষা এ পর্যন্ত সময়ের গর্ভে কম বিলীন হয়ে যায়নি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে দেওয়া প্রশান্ত হালদারের ভাষ্য, “বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে আগুন লাগে। মূল বাসভবন দোতালার পেছনে প্রাচীর সংলগ্ন একটি খোলা টিনের চালায় বিচালিতে আগুনের সূত্রপাত হয়। এরপর লাগোয়া খড়ির গাদায় এবং ক্রমান্বয়ে টিনের স্টোররুম ও গোয়াল ঘরেও আগুন ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় লোকজন ও কালীগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের সহযোগিতায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।”
আগুন লাগার ঘটনায় ‘নানা রকম সন্দেহ’র কথা তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, “এর আগেও অজ্ঞাতনামা কেউ রাতের বেলায় আমাদের রান্নাঘরে জানালায় ৩/৪ বার মানুষের মল মাখিয়ে রেখে যায়। একাধিকবার আমাদের টিনের ঘরের চালে ও দোতলা ঘর লক্ষ্য করে আধলা ইট ও ঢিল নিক্ষেপ করে। বিষয়টি নিয়ে আমরা স্থানীয়ভাবে আলোচনা করি।” রঘুনাথপুরে হালদারদের যে বাড়িটিতে বারবার উৎপীড়নের তীর ছোড়া হয়েছে এর পেছনে উচ্ছেদ আর দখলের মর্মন্তুদ অপখেলার বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়ার অবকাশ মনে হয় নিশ্চয় কম।
- ট্যাগ:
- মতামত
- অগ্নিসংযোগ