
পোলট্রি বর্জ্যে দূষণ ও স্বাস্থ্যের ক্ষতি
ঢুলিভিটা থেকে ধামরাই উপজেলার একটি গ্রামের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। যাব সীতি গ্রামের আলাদিন পার্কে। হঠাৎ নাকে একটা উৎকট গন্ধ এসে লাগল। যতই এগোচ্ছি গন্ধটা তত বেশি উগ্র হয়ে উঠছে। নাক দিয়ে ঢুকছে দুর্গন্ধযুক্ত বাতাস, পেটের ভেতরটা যেন ঘুলঘুল করে উঠছে। কারণটা কী? একটু এগিয়ে যেতেই ব্যাপারটা খোলাসা হয়ে গেল। রাস্তার ধারে ফসলের খেতের মাঝে কয়েকটা পোলট্রি খামার দেখা গেল। বাঁশ ও আরসিসি খুঁটি দিয়ে মাটি থেকে প্রায় ১০-১২ ফুট উঁচু মাচাং করে তৈরি করা হয়েছে সেসব খামার। টিনের চালা, বেড়ায় ছালা বা পলিথিন। ঘরের ভেতর তাক করে শত শত মুরগি পালন করা হচ্ছে। সেসব মুরগির বিষ্ঠা ও বর্জ্য পড়ছে মাটিতে। আর সেসব বর্জ্যের পচন থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে চারদিকে, যা বাতাসের নির্মলতাকে হরণ করছে। বর্ষার সময় সেসব বর্জ্য পানিতে মিশে গিয়ে ফসলের খেতে চলে যাচ্ছে। পাকা রাস্তা দিয়ে অনেক মানুষই চলাচল করছে।
গ্রামের মানুষের হয়তো ওই দুর্গন্ধ গা সওয়া হয়ে গেছে, কিন্তু আমাদের মতো নতুন লোকদের জন্য এ এক বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা। মেজাজ হারিয়ে চিৎকার করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো বলতে ইচ্ছে করছে—‘যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু,/নিভাইছে তব আলো,/তুমি কি তাদের ক্ষমা/করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ধামরাইয়ের এ গ্রামে পোলট্রি খামার অন্যান্য গ্রামের চেয়ে কম আছে। সবচেয়ে বেশি রয়েছে সনোরা ইউনিয়নে। ভালুম, দেওনাই, গোলকান্দা ইত্যাদি গ্রামেও আছে অনেক পোলট্রি খামার। ধামরাই উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ২০২২ সালের এক তথ্যসূত্র মতে, এ উপজেলাতেই রয়েছে ৩৪৫টি পোলট্রি খামার। আর সারা দেশে প্রায় দেড় লাখ খামার রয়েছে। এসব খামারে উৎপাদিত মুরগির ডিম ও মাংস এখন এ দেশে প্রাত্যহিক খাদ্য ও প্রোটিনের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। লাখ লাখ লোকের জীবিকা ও জীবন এসব খামারের ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী ও যুবাদের কর্মসংস্থানের একটি বড় ক্ষেত্র হলো পোলট্রিশিল্প। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র গড়ে ওঠা অধিকাংশ পোলট্রি খামার এখন পরিবেশদূষণ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য অন্যতম প্রধান হুমকি হয়ে উঠেছে। এসব খামার থেকে নির্গত বর্জ্য ও আবর্জনা সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা না করার কারণে তা মাটি, পানি, বাতাস দূষিত করছে। এসব দূষণের ফলে মানুষের স্বাস্থ্যেরও চরম ক্ষতি হচ্ছে।
দেশে কয়েক দশক ধরে পোলট্রি খামারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অপরিকল্পিত এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এ খামারগুলো গড়ে না ওঠার কারণে তা থেকে উৎপাদিত মুরগিও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে পালিত হচ্ছে না। এ কারণে উৎপাদন থেকে শুরু করে পরিবহন ও বাজার ব্যবস্থাপনা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই ঘটছে পোলট্রি দূষণ। কোনো স্থানের পরিবেশগত অবস্থার প্রেক্ষাপটে পোলট্রি খামারের রয়েছে সুদূরপ্রসারী প্রভাব। দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে সেসব বর্জ্য থেকে শুধু বাতাসে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে না, সেই দুর্গন্ধ ডেকে আনছে মাছি। সেই মাছি আবার রোগজীবাণু ছড়িয়ে মানবদেহে রোগের সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। এমনকি তা অনেক সময় হাঁস-মুরগিরও রোগের কারণ হয়ে উঠছে। নিঃসন্দেহে মুরগির বিষ্ঠা একটি উচ্চ পুষ্টিসমৃদ্ধ উত্তম জৈব সার। কিন্তু কাঁচা বিষ্ঠা কখনো সেই জৈব সার হিসেবে মাটি ও ফসলের উপকার করে না, বরং অ্যামোনিয়া গ্যাস সৃষ্টি করে ফসলের ক্ষতি করে। মুরগির বিষ্ঠা তখনই উপকার বয়ে আনে, যখন তা পচিয়ে জমিতে ফেলা হয়। কিন্তু সুব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জৈব সার হিসেবে উৎপাদন করে তা জমিতে প্রয়োগ করা হয় না। পোলট্রি খামারসংলগ্ন জমিগুলোতে সচরাচর কাঁচা বিষ্ঠা সরাসরি প্রয়োগ করা হয়। খামারের তলায় যেখানে এসব বর্জ্য জমা হয়, সেখানে তা পচনের ফলে তা থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস বিশেষ করে অ্যামোনিয়া ও মিথেন তৈরি হয়, যা বায়ুমণ্ডলকে দূষিত এবং এর তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে।
পোলট্রিশিল্প এ দেশের মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য এক উল্লেখযোগ্য হুমকি। গবেষকেরা সম্প্রতি ১৬টি পোলট্রি খামারে খাদ্য পরীক্ষা করে ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, সিসা, তামা, ম্যাঙ্গানিজ, নিকেল ও আয়রন—এই ৭টি ভারী ধাতুর উপস্থিতি পেয়েছেন, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি। ফলে পোলট্রির মাংস ও ডিম খাওয়ার মাধ্যমে নিমেষে তা মানবদেহে প্রবেশ করছে। ফলে দেহে কিডনি ও যকৃৎ নষ্ট হয়, ক্যানসার, শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা, চর্মরোগ ইত্যাদি দেখা দেয়। অপরিশোধিত পোলট্রি বর্জ্য ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও পরজীবীদের আশ্রয় এবং উৎপত্তিস্থল, যা মানুষের খাদ্য ও পানীয় জলকে সংক্রমিত করে।