ড. ইউনূসের পদত্যাগের কথা উঠল কেন

দেশ রূপান্তর জাকির হোসেন প্রকাশিত: ২৫ মে ২০২৫, ০৯:৩১

বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানোর দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন শেষ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে গিয়ে ঠেকেছে। আন্দোলন ৪৮ ঘণ্টার জন্য স্থগিত   ঘোষণা করা হলেও সরকারের দুজন ছাত্র উপদেষ্টা ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে আবার আন্দোলন কর্মসূচি দেওয়া হতে পারে বলেও জানিয়েছেন ইশরাক হোসেন। গত সপ্তাহ জুড়ে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের পদত্যাগের দাবি জানিয়ে আসছেন বিএনপির  নেতাকর্মীরা। অন্যদিকে বিএনপির এই দাবির পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় সংস্কার সুপারিশ বাস্তবায়ন না হলে, অন্তর্বর্তী সরকারের তিনজন উপদেষ্টাকে ‘বিএনপির মুখপাত্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করে পদত্যাগে বাধ্য করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির এক শীর্ষনেতা। এই তিনজন হলেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল, অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ। অন্তর্বর্তী সরকারের নয় মাসে দুটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম থেকে ছয় উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবি উঠলেও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগের দাবি ওঠা তো দূরের কথা, তার বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনাও শোনা যায়নি। তা সত্ত্বেও গত বৃহস্পতিবার আকস্মিকভাবে গুঞ্জন উঠে প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করতে চাইছেন। হঠাৎ কেন এই গুঞ্জন? ওই দিন উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে দীর্ঘক্ষণ উপদেষ্টাদের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা গেছে, ঢাকায় প্রতিদিন সড়ক আটকে আন্দোলন, সংস্কারসহ বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য না হওয়া, রাষ্ট্রীয় কাজে নানা পক্ষের অসহযোগিতার বিষয়টি আলোচনায় আসে। আলোচনার একপর্যায়ে কাজ করতে না পারার বিষয়টি তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি আরও বলেন, সংস্কারের বিষয়েও এখনো তেমন কিছু হলো না। তাহলে তিনি কেন থাকবেন? ওই দিন রাতে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম গিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করতে। ফিরে এসে মিডিয়াকে নাহিদ জানান প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করার কথা ভাবছেন। তিনি বলেন, ‘স্যার বলছেন আমি যদি কাজ করতে না পারি... যে জায়গা থেকে তোমরা আমাকে আনছিলা একটা গণঅভ্যুত্থানের পর। দেশের পরিবর্তন, সংস্কার...। কিন্তু যে পরিস্থিতি যেভাবে আন্দোলন বা যেভাবে আমাকে জিম্মি করা হচ্ছে। আমি তো এভাবে কাজ করতে পারব না।’


দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে ক্ষোভ ও হতাশা থেকে এ কথা বলেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিগত নয় মাস ধরে নানা ইস্যুতে প্রায় প্রতিদিনই নগরীতে আন্দোলন হচ্ছে। রাজপথ বন্ধ করে এসব আন্দোলনের কারণে নগরজুড়ে যানজট জনভোগান্তি চরম আকার ধারণ করে। এসব ভোগান্তির প্রেক্ষিতে সরকারকে আন্দোলনকারীদের আশ্বস্ত করতে হয়। কিছু কিছু দাবি চাপের মুখে পূরণও করতে হয়েছে। গত সপ্তাহে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র পদে ইশরাক হোসেনের শপথ না পড়ানোর কারণে বড় আন্দোলন হয়েছে নগর ভরন এলাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের নেতা সৌম্য হত্যার বিচারের দাবিতে আন্দোলন হয়েছে শাহবাগে, এনসিপির নির্বাচন কমিশন ঘেরাও কর্মসূচি পালিত হয়েছে। প্রতিটি দাবি যেন নাছোরবান্দা পরিস্থিতি। এসব কারণে নগরবাসীর অস্বস্তি যেমনি বাড়ছে তেমনি সরকারের ওপর মানুষের আস্থার জায়গায় চিড় ধরছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকার পরিচালনার দায়িত্ব যাদের মাধ্যমে নিয়েছিলেন, সেই ছাত্রদের মধ্য থেকেও সরকারকে অনেকটা নাকি জিম্মি দশায় ফেলা হয়েছে। যদি সত্য হয়, তাহলে এসব কারণে অসন্তুষ্ট হতেই পারেন ড. ইউনূস। সেটা অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। তবে কোনো উপদেষ্টার কথা, সিদ্ধান্ত বা কাজ যদি জনমনে অসন্তোষ তৈরি করে, জাতিকে বিভ্রান্ত করে তবে সরকারের প্রধান হিসেবে তাকেও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। এটাই স্বাভাবিক। এই পরিস্থিতিতে পদত্যাগ করে চলে গেলে তো ব্যর্থতাকে স্বীকার করে নেওয়া। যেটা উপদেষ্টা পরিষদের অন্য সদস্যদের চেয়ে ব্যক্তি ড. ইউনূসের ওপর বেশি প্রভাব ফেলবে।


প্রশ্ন উঠতে পারে, দেশের বর্তমান সামগ্রিক পরিস্থিতিতে ড. ইউনূসের কি পদত্যাগ করা উচিত? আসলে ড. ইউনূসের নয় মাসের সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনার সময় এখনো আসেনি। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ সংস্কার ও আগামী জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিষয়ে মূল্যায়ন হতে পারে, তার আগে না। কিন্তু তাকে পদত্যাগের অভিপ্রায় প্রকাশের অভিমানের জায়গায় কেন যেতে হলো? হঠাৎ কেন তার পদত্যাগের আলোচনা? মূলত ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের চাপ, সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অনৈক্য, মব সন্ত্রাস, রাখাইনের জন্য মানবিক করিডর বিতর্ক এবং চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনা বিদেশিদের হাতে দেওয়ার পরিকল্পনাগুলো মোটা দাগে ড. ইউনূস সরকারকে হয়তো চাপে ফেলেছে। এ ছাড়া ইশরাকের মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানো নিয়ে গরিমসি করা সরকারের সঙ্গে বিএনপির বিভাজন রেখা স্পষ্ট করেছে। তবে বিএনপি নেতারা বলছেন, নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ও তিনজন উপদেষ্টার পদত্যাগের তাদের দাবি এড়াতে প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের ভাবনার কথা সামনে আনা হয়েছে। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালেহউদ্দিন আহমেদ একটি গণমাধ্যমে বলেছেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় আবেগ সৃষ্টি করার কিছু নেই। যখন নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দাবি করা হচ্ছে, তখন এ ধরনের আবেগের কথা বলা হচ্ছে। সরকারের দুর্বলতার কারণে পরিস্থিতি সামলাতে যখন ব্যর্থতার প্রশ্ন আসছে, তখন পদত্যাগের এই ভাবনার কথা রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি এক ধরনের হুমকি বা সতর্কতা। জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বরাবরই বলেছেন, আগামী ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ এবং ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন দাবি করে আসছে। সম্প্রতি সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান কর্মকর্তাদের নিয়ে এক বৈঠকে ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন হওয়া উচিত মন্তব্য করেছেন, যা তিনি আগেও বলেছিলেন। তার মতে, দেশের ভবিষ্যৎ পথনির্ধারণের অধিকার একটি নির্বাচিত সরকারেরই রয়েছে। ওই অনুষ্ঠানে নির্বাচন ছাড়াও রাখাইনের জন্য মানবিক করিডর এবং মব বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির বিষয়সহ সমসাময়িক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা বলেছেন সেনাপ্রধান। যা সংবাদমাধ্যমেও প্রকাশ হয়েছে। সেনাপ্রধান মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডর-সংক্রান্ত আলোচনার বিষয়ে বলেছেন, রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডর বিষয়ে সিদ্ধান্ত একটি নির্বাচিত সরকার থেকেই আসতে হবে এবং তা বৈধ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই হতে হবে। এখানে জাতীয় স্বার্থ দেখতে হবে। যা করার জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করেই করতে হবে। যা-ই করা হোক না কেন, পলিটিক্যাল কনসেনসাসের (রাজনৈতিক ঐকমত্য) মাধ্যমে সেটা হতে হবে। করিডর নিয়ে সেনাপ্রধানের এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান আলোচনাটি গুজব আখ্যা দিয়ে বলেছেন, রাখাইনের জন্য করিডর নিয়ে সরকার কারও সঙ্গে কোনো কথা বলেনি এবং বলবেও না। তবে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ত্রাণ সরবরাহের একটি ‘চ্যানেল বা পাথওয়ে’ তৈরির জাতিসংঘের প্রস্তাব বাংলাদেশ বিবেচনা করছে। যেহেতু সংঘাতের কারণে সাহায্য সরবরাহের অন্যান্য সব পথ বর্তমানে অকার্যকর, তাই বাংলাদেশই এখন একমাত্র সম্ভাব্য বিকল্প। জাতিসংঘের সাহায্য নিয়ে বাংলাদেশে একটি করিডর দেওয়ার যে গুজব  তৈরি হয়েছে, আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলছি যে, করিডর নিয়ে আমাদের সঙ্গে কারও কোনো কথা হয়নি। অথচ পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন গত ২৭ এপ্রিল সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, রাখাইনে মানবিক সহায়তা পাঠানোর জন্য বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে মানবিক করিডর  তৈরি করতে চায় জাতিসংঘ। এ বিষয়ে শর্তসাপেক্ষে নীতিগতভাবে সম্মত আছে অন্তর্বর্তী সরকার। এখানে প্রশ্ন ওঠে, ২৭ এপ্রিল পররাষ্ট্র উপদেষ্টা নীতিগত সিদ্ধান্তের কথা বলেছিলেন আর ২১ মে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেছেন, কারও সঙ্গে আলোচনা হয়নি। তবে এতদিন গুজবটা ছড়াতে দিল কেন সরকার? বিষয়টি এখানেই শেষ নয়, এরই প্রেক্ষিতে ওই দিনই পররাষ্ট্র উপদেষ্টা নিজেও বিব্রত হয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, এ বিষয়ে কোনো প্রশ্নের উত্তর তিনি দেবেন না। সেনাপ্রধান বাহিনীর কর্মকর্তাদের নিয়ে ওই বৈঠকে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশিদের হাতে দেওয়া প্রসঙ্গে বলেছেন, এখানে স্থানীয় মানুষ ও রাজনৈতিক নেতাদের মতামত প্রয়োজন হবে। রাজনৈতিক সরকারের মাধ্যমে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। এ ছাড়া মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধেও কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন সেনাপ্রধান। তবে সরকারের সংস্কার প্রসঙ্গে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, কী সংস্কার হচ্ছে, কীভাবে হচ্ছে, এ বিষয়ে তার কিছু জানা নেই। এ বিষয়ে তার সঙ্গে কোনো পরামর্শ বা আলোচনা করা হয়নি। সেনাপ্রধানের এই কথাগুলো সংবাদ মাধ্যমে আসার পর সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর দূরত্ব মাপতে শুরু করেছে কেউ কেউ। যদিও সেনাপ্রধান বর্তমান সরকারকে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার কথাই জোর দিয়ে বলেছেন।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

এই সম্পর্কিত

আরও