
সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও নারী কেন ক্ষমতার ন্যায্য হিস্যা পাবে না
সাধারণভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনকেই গণতন্ত্র বলে। কোনো একটি বৃহৎ পরিসরে, যেমন রাষ্ট্রে জনমতের সংখ্যাগরিষ্ঠতা মাপা সহজ নয়। তাই বিভিন্ন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে মানুষ। মাপার নিক্তি যেমনই হোক না কেন, মূল প্রতিপাদ্য থাকে সবচেয়ে বেশি মানুষের মত ও তাঁদের প্রতিনিধি বেছে নেওয়া। এর আলোকে সবচেয়ে প্রচলিত ও জনপ্রিয় পদ্ধতি হলো দেশকে সংসদীয় আসনে বিভক্ত করে তাতে সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের চর্চা।
সাধারণ হিসাবে যাদের কোনো কিছু পাওয়ার কথা নয়, সেটা তাদের জন্য সংরক্ষিত রাখাকেই কোটা বা ইতিবাচক বৈষম্য বলে। আর যেটা স্বাভাবিকভাবেই পাওয়ার কথা, সেটাকে বলে ন্যায্য হিস্যা। মোটকথা, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জন্য যা বরাদ্দ থাকে, তাকে কেউ কোটা বলে না, বলে অধিকার।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত সর্বশেষ জনশুমারি অনুসারে দেশের নারী-পুরুষের অনুপাত হলো ৫০ দশমিক ৯৩ ও ৪৯ দশমিক শূন্য ৭। নিকটতম পূর্ণ সংখ্যায় দেখালে জনসংখ্যার ৫১ শতাংশ নারী ও ৪৯ শতাংশ পুরুষ। সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন, ন্যায্য হিস্যা আর দেশে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যাধিক্য—সবকিছু একত্রে বিবেচনায় নিলে দেশের ৫১ শতাংশ সংসদ সদস্য নারী হওয়াই স্বাভাবিক। সে হিসাবে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ সংসদ সদস্য নারী হওয়া উচিত ছিল!
সংখ্যাগরিষ্ঠের রাজনৈতিক আধিপত্য ফলানোর রীতি অনুসারে যেহেতু জনসংখ্যায় নারী বেশি, সেহেতু কিছু ব্যতিক্রম বাদে ৩০০ আসনেই নারী ভোটারও বেশি হওয়ার কথা। এমন একটা দৃশ্যের কথা ভাবা যাক: কোনো এক ‘স্নিগ্ধ’ নির্বাচনী ভোরে দেশের নারীরা যদি নিজেদের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে বঞ্চিত বর্গ হিসেবে ধরে এই বলে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন যে তাঁরা কেবল একজন নারীকেই ভোট দেবেন। তাহলে আক্ষরিক অর্থেই পুরুষদের ‘হাতে হারিকেন ধরিয়ে দিয়ে’ ৩০০ জন এমপিই নারী নির্বাচিত হবেন!
কিন্তু রাষ্ট্রের এই সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে বাস্তবে কীভাবে দেখা হয় বা কতটুকু স্থান দেওয়া হয় রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক পরিসরে? সদ্য সমাপ্ত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে জাতীয় সংসদে নারীদের সরাসরি নির্বাচন বা প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে যা হলো, সেটাকে অনেকে উল্টো যাত্রার সঙ্গে তুলনা করেছেন। জাতীয় সংসদে শুধু পুরুষদের জন্য আইন প্রণয়ন করা হয় না, নারী-পুরুষনির্বিশেষে সব মানুষের জন্য। অথচ সেসব আইনে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ, অর্থাৎ নারীর মতামত দেওয়ার সুযোগ না থাকা কোনো ইতিবাচক ঘটনা নয়।
সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রস্তাব করেছিল, স্থানীয় সরকারব্যবস্থার আদলে প্রতি তিনটি সাধারণ আসনের জন্য একটি নারী আসন নির্ধারণ করে তা সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের মতে, প্রতিটি আসনে একজন পুরুষের পাশাপাশি একজন নারীও নির্বাচিত হওয়া উচিত। অন্যদিকে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন সংসদে অতিরিক্ত ১০০ আসন সংযোজন করে সেগুলো নারীদের জন্য ঘূর্ণমানভাবে সংরক্ষণের প্রস্তাব দেয়।
সংসদে নারী আসনের ব্যাপারে স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত যা চলছে, তা হলো ‘সংরক্ষিত আসন’, যা ক্রমে ক্রমে বেড়ে বর্তমানে ৫০টিতে এসে দাঁড়িয়েছে। তাঁরা সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত আসনের অনুপাতে মনোনীত হন। এতে জনগণ সরাসরি ভোট দিয়ে এই নারী সদস্যদের নির্বাচিত করতে পারেন না। এটাকে নাগরিক সমাজ ও নারী অধিকারকর্মীরা বহুদিন ধরেই অগণতান্ত্রিক ও বৈষম্যমূলক বলে আসছেন। কিন্তু জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যধারায় এ বিষয়ে অগ্রগতি প্রশ্নে মতৈক্য তো দূরে থাক, এতই মতভিন্নতা দেখা গেল যে শেষে নারীদের পক্ষ থেকে জানাতে হয়, এই মতভেদের তোড়ে যেন বিদ্যমান সংরক্ষণব্যবস্থাও ভেস্তে না যায়!
এরপর কমিশন সর্বশেষ যে প্রস্তাব দেয়, তা হলো আগের ৫০ সংরক্ষিত আসন রেখেই সাধারণ আসনে আগামী নির্বাচনে কমপক্ষে ৫ ভাগ আসনে নারীকে মনোনয়ন দেওয়া এবং এভাবে তা ৩৩ ভাগে উন্নীত না হওয়া পর্যন্ত ৫ ভাগ হারে বাড়াতে হবে। কিন্তু এতেও ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা আপত্তি দেওয়া হয়েছে। এটা নাগরিক ও নারী সমাজে গভীর ক্ষোভ ও হতাশার জন্ম দেয়। নারীনেত্রীরা ‘ভোট দেবেন না’ বলেও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানালে কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ ‘ভোট দেব না’কে রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে চাপ সৃষ্টি করার পরামর্শ দিতে দেখা গেছে। (প্রথম আলো, ২ আগস্ট ২০২৫)
এ ক্ষেত্রে আমরা বিশ্বে আইনসভায় নারীর সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী প্রথম দেশ রুয়ান্ডার অভিজ্ঞতা থেকে পাঠ নিতে পারি। সর্বশেষ নির্বাচনে সে দেশের নিম্নকক্ষ চেম্বার অব ডেপুটিজে ৬৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং উচ্চকক্ষ সিনেটে ৫৩ দশমিক ৮ শতাংশ আসনে নারী সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এ প্রশ্নে এমা রুবাগুমিয়া ফুরাহা নামের রুয়ান্ডার একজন নারী আইনপ্রণেতা বলেন, ‘পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আমরা নারীরা রুয়ান্ডার মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি। এখন যদি আমাদের বাদ দেওয়া হতো, তবে কীভাবে আমরা উন্নয়ন নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে কথা বলতাম? আজ আমরা যে আইনই বিবেচনা করি, তাতে লিঙ্গসমতার বিষয়টি সর্বাগ্রে বিবেচনায় নেওয়া হয়—পরিবার–সংক্রান্ত বিষয়ে তো বটেই, বাজেট ও দরপত্র আহ্বানেও।’ (ফরাসি সাময়িকী লা মদে, ২০২৪)