বন্দর পরিচালনা: জাতীয় সক্ষমতা তৈরি না করে বিদেশনির্ভরতা কেন

প্রথম আলো মোশাহিদা সুলতানা প্রকাশিত: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:৫১

যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর–পশ্চিম ম্যাসাচুসেটসে হুসাক পর্বতমালার মধ্য দিয়ে ৪ দশমিক ৭ মাইল দীর্ঘ একটি রেলওয়ে টার্মিনাল নির্মাণ শুরু হয় ১৮৫১ সালে। ২৪ বছর পর ১৮৭৫ সালে নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। নির্মাণ শুরুর আগে যতটা কঠিন ভাবা হয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন ছিল কাজটি। নির্মাণের সময় ১৯৬ জন শ্রমিক নিহত হয়েছিলেন।


সেই সময়ের তুলনায় পুরকৌশলের একটি ল্যান্ডমার্ক প্রকল্প হিসেবে স্বীকৃতি ছিল এটি। আলবার্ট হির্শমান নামের একজন অর্থনীতিবিদের একটি তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নিউ ইয়র্কার–এর সাংবাদিক ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েল এই গল্প উদাহরণ হিসেবে দেখান।


হির্শমানের মতে, সৃজনশীলতা আমাদের জন্য সব সময় একটি বিস্ময় হিসেবে আসে; তাই আমরা কখনোই এর ওপর নির্ভর করতে পারি না এবং এটি ঘটে যাওয়ার আগে আমরা এর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করি না। সচেতনভাবে এমন কাজগুলোতে যুক্ত হতে চাই না, যেখানে সাফল্য অর্জন করতে সৃজনশীলতার প্রয়োজন হয়। তাই আমাদের সৃজনশীলতাকে সম্পূর্ণরূপে ব্যবহার করার একমাত্র উপায় হলো, কাজটা যতটা কঠিন, তার চেয়ে কম কঠিন হিসেবে মূল্যায়ন করা।


হির্শমান এই নীতির নাম দিয়েছেন ‘হাইডিং হ্যান্ড প্রিন্সিপাল’। এর কারণ হলো, প্রকল্পের কঠিন দিকগুলো একটি ‘অদৃশ্য হাত’ দিয়ে পরিকল্পনাকারীর কাছ থেকে প্রাথমিকভাবে লুকানো হয়, যেন পরে সৃজনশীলতা ব্যবহার করে কাজটি সম্পন্ন করা যায়। এই নীতির খারাপ ও ভালো উভয় দিকই আছে।


 তবু ধরে নেওয়া হয়, আমরা যে সৃজনশীল হতে চাই না, এই হতে না চাওয়াকে অতিক্রম করার জন্য আমাদের কিছু ঝুঁকি নিতে হয়; অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। পূর্ব অভিজ্ঞতা এখানে পথ দেখায়। অনিশ্চিত পৃথিবীতে এই নীতি অনুসরণ করে অনেকেই সামনের দিকে এগিয়ে যান।


২.
লালদিয়া চরে চট্টগ্রাম বন্দরের একটি টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য ১৭ নভেম্বর এপিএম টার্মিনালসের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার একটি চুক্তি করেছে। চুক্তির শর্ত প্রকাশ না করে মাত্র ১৩ দিনের মধ্যে ৩৩ বছরের চুক্তি করা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। ‘হাইডিং হ্যান্ড’ নীতি অনুযায়ী, এই বিতর্কে উভয় পক্ষই (চুক্তির পক্ষে অবস্থান নেওয়া এবং চুক্তির বিরোধিতাকারী) কিছু বাস্তব ভবিষ্যৎ সমস্যাকে তাদের মতো উপস্থাপন করছে। যেমন এপি মোলার এবং সরকার বন্দরের চুক্তির শর্ত আড়াল করে এর সম্ভাব্য ঝুঁকিকে তাদের জায়গা থেকে উপস্থাপন করছে। অন্যদিকে তড়িঘড়ি করে করা চুক্তির বিরোধিতাকারীরা বিকল্প হিসেবে জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির পথে বাধাগুলোকে তাদের মতো করে দেখাতে চাইছে।


উপায় ভিন্ন হলেও উভয়ই এখানে একটি অচলাবস্থা থেকে পরিত্রাণ চায়। তবে এখানে পার্থক্য রয়েছে কর্তৃত্ব নিয়ে। এ ক্ষেত্রে কিছু প্রশ্ন উঠে আসে। কার নিয়ন্ত্রণে, কীভাবে এই সংকট দূর হবে? কার সৃজনশীলতা দিয়ে বন্দরের কর্মদক্ষতা বাড়ানো যায়? আমরা কি আশা করব, ইজারা দিয়ে বিদেশি কোম্পানির ওপর সৃজনশীলতার দায় চাপিয়ে বন্দর দুর্নীতিমুক্ত করা যাবে, নাকি বাংলাদেশ তার নিজস্ব মালিকানার দায় থেকে সৃজনশীলতা ব্যবহার করে দুর্নীতি মোকাবিলা করতে পারবে? কে এই সৃজনশীলতা ব্যবহারে কার কাছে, কতটুকু দায়বদ্ধ? বিদেশি কোম্পানি ব্যবসা করতে আসে, দুর্নীতি যদি কোনো কারণে তার মুনাফা বৃদ্ধি করে, তাহলে কি দুর্নীতি রোধের দায় তার থাকবে? একইভাবে বন্দর ব্যবস্থাপনায় জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির কথা বলে পরবর্তী সরকার যদি তা না করে, তাহলে কী হবে?


এখানেই গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রসঙ্গ চলে আসে। বিগত আমলে আমরা দেখেছি, সীমাহীন দুর্নীতি থেকে লাভবান হওয়ার কারণে একটি নির্বাচিত সরকার স্বৈরাচারী সরকারে পরিণত হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব ছিল সেই দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত এবং দুর্নীতি রোধে একটি রূপরেখা তৈরি করা। তা না করে অন্তর্বর্তী সরকার আগের সরকারের পরিকল্পিত, কিন্তু অবাস্তবায়িত প্রকল্প অস্বচ্ছতা ও জবাবদিহি ছাড়াই বাস্তবায়ন করছে।


৩.
বাংলাদেশের জনগণ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি, অদক্ষতা, অনিয়ম দেখতে দেখতে হতাশ। সরকারি প্রতিষ্ঠানে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁরা হতাশ হয়ে ভেবেছিলেন, সেবা খাত ব্যক্তি খাতে দিলেই সমস্যার সমাধান হবে। ১৯৮০–এর দশক থেকে অসংখ্য রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, বেসরকারীকরণ করা হয়েছে। তখন বলা হয়েছিল, দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ঠিকমতো কাজ করে না, রয়েছে দুর্নীতি ও অদক্ষতা। কাজেই বেসরকারি ব্যাংক খুলতে হবে।


এরপর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বেড়ে গেল। এখন ৩৫ শতাংশ খেলাপি ঋণ নিয়ে বাংলাদেশ শীর্ষ খেলাপি ঋণের তালিকায় স্থান পেয়েছে। পাঁচটি খেলাপি ব্যাংককে একীভূত করে সেই সরকারি মালিকানায় এনে তাদেরকে আবার বাঁচানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। অথচ এই সরকারি মালিকানার প্রতি অনাস্থা থেকেই এই ব্যাংকগুলোকে গঠন করা হয়েছিল।


একইভাবে চট্টগ্রাম বন্দর বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাইফ পাওয়ার টেকের কাছে ইজারা দেওয়া হলেও সেখানেও দুর্নীতি কমেনি। এখন বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে ইজারা দিলে এই দুর্নীতি বন্ধ হবে। এ রকম চিন্তা থেকেই দুই বছর আগে পতেঙ্গা টার্মিনালকে সৌদি কোম্পানি রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনালের কাছে ইজারা দেওয়া হয়েছিল। ১৫ মাস পরও এই টার্মিনাল থেকে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায়নি। চুক্তি অনুযায়ী সময়মতো বিনিয়োগ হয়নি, কর্মদক্ষতাও বাড়েনি।


এরপরও অন্তর্বর্তী সরকার চট্টগ্রামের নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনালকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ডের কাছে ইজারা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার গত এপ্রিল মাসেই মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দরে একটি টার্মিনাল নির্মাণের জন্য জাপানি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছে। তবে টার্মিনালটি পরিচালনা করবে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর কর্তৃপক্ষ। তাই এটা নিয়ে তেমন কোনো বিতর্ক হয়নি।


কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার এখানেই থামেনি। লালদিয়া চরে আরেকটি টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার চুক্তি সম্পন্ন করেছে ডেনমার্কের কোম্পানি এপিএম টার্মিনালসের সঙ্গে এবং পানগাঁও নৌ টার্মিনাল পরিচালনার চুক্তি করেছে সুইজারল্যান্ডের কোম্পানি মেডলগের সঙ্গে। কারণ হিসেবে বিদ্যমান দুর্নীতি বন্ধ করা ও দক্ষতা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও