
আটলান্টিকের তীরে বাংলাদেশের রাজনীতির ঢেউ
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামান্য আলোড়ন সৃষ্টি হলে নিউইয়র্কেও বাংলাদেশি ইমিগ্রান্টদের মধ্যে সে আলোড়নের তীব্রতা আরও প্রবলভাবে অনুভূত হয়। গত কয়েকদিন ধরে বাংলাদেশে যা ঘটে চলেছে, তার ঢেউ আটলান্টিক মহাসাগরের তীরবর্তী এ মহানগরীতে বসবাসকারী রাজনৈতিক সচেতন বাংলাদেশিদের একটি অংশকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। আরেকটি অংশ দেশে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির আশঙ্কাকে কাঙ্ক্ষিত ও অনিবার্য বিবেচনা করে উচ্ছ্বসিত বোধ করছে। গত বছরের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পলায়ন ও আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে দেশ রাহুমুক্ত হওয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের হাসিনাবিরোধী মহল, অর্থাৎ বিএনপি-জামায়াত সমর্থকদের মধ্যে আনন্দের জোয়ার বয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থকরা শেখ হাসিনার অবিশ্বাস্য পতনে হতচকিত ও মুষড়ে পড়লেও মুহূর্তে নিজেদের সামলে নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। শেখ হাসিনা তাদের সমাবেশে ভিডিও কনফারেন্সে বক্তৃতা দিয়ে তাদেরকে উজ্জীবিত করেছেন এবং তারা যথার্থই উজ্জীবিত হয়েছেন। দেশে যেহেতু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দৌড়ের ওপর রয়েছেন, আত্মগোপন করেছেন এবং গ্রেফতার হয়ে কারাগারে কাটাচ্ছেন, প্রবাসী আওয়ামী লীগাররা সেক্ষেত্রে নিউইয়র্কের অন্যতম বাংলাদেশি অধ্যুষিত জ্যাকসন হাইটস এলাকায় সোচ্চার থেকে তাদের অস্তিত্ব জাহির করতে দ্বিধা করছেন না। পাশাপাশি বিএনপির প্রবাসী নেতাকর্মীরাও তাদের দলের কেন্দ্রীয় কর্মসূচি অনুযায়ী একই স্থানে সমাবেশ আয়োজন অব্যাহত রেখেছেন।
বাংলাদেশের মতো রাজনীতিতে পেশিশক্তির প্রভাবদুষ্ট দেশে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের পাশাপাশি অবস্থানের কোনো সুযোগ নেই। অন্তত আওয়ামী লীগের মতো একটি দল বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকলে মাঠে-ময়দানে বিরোধী দলের প্রকাশ্যে সভা-শোভাযাত্রা করা অসম্ভব ব্যাপার। বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ কোনো কর্মসূচিতেও আওয়ামী লীগ যেনতেন অজুহাতে গোলযোগ বাঁধাবে, সরকারবিরোধী সমাবেশে হামলা চালাবে এবং রক্তপাত ঘটাবে। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান এ দেশের নাগরিক-অনাগরিক নির্বিশেষে সবার মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পাশাপাশি সবার জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। অতএব, বাংলাদেশি ইমিগ্রান্টরা দেশের যে দলের প্রতিই তাদের রাজনৈতিক আনুগত্য পোষণ করুক, তারা পাশাপাশি জড়ো হয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে বক্তৃতা করে ও স্লোগান দেয়; কিন্তু কেউ কারও ওপর চড়াও হয় না। চড়াও হলেই আইন প্রয়োগকারীরা তাদের পাকড়াও করে ফৌজদারি আইনে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করবে। যুক্তরাষ্ট্রে ফৌজদারি আইনে দোষী সাব্যস্ত হলে জেল-জরিমানা ছাড়াও সংশ্লিষ্টের বৈধতা লাভের সুযোগ হারানোর আশঙ্কা থাকে, এমনকি গ্রিনকার্ডধারী হলে গ্রিনকার্ড বাতিল, অপরাধ গুরুতর প্রমাণিত হলে যারা নাগরিকত্ব অর্জন করেছেন, তাদের নাগরিকত্বও প্রত্যাহার করা হতে পারে।
অতএব, রাজনৈতিক বিশ্বাস ও দলসংশ্লিষ্টতার কারণে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আওয়ামী লীগার ও বিএনপি-জামায়াতের সমর্থকরা পরস্পরের বিরুদ্ধে বাগাড়ম্বরে লিপ্ত হলেও তারা পরস্পর সংযম ও সহিষ্ণুতার পথ ত্যাগ করতে পারেন না। আওয়ামী লীগ সমর্থকরা মনের ভেতরে আক্রমণাত্মক ভাব চাপা রাখেন এবং তাদের ক্ষোভের আগুন প্রতিপক্ষের ওপর ছড়িয়ে দিতে পারেন না। বিএনপি-জামায়াত সমর্থকরা দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তাদের দলের নেতাকর্মীদের ওপর বিগত সাড়ে ১৫ বছর ধরে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকারের চালানো জুলুম-নির্যাতন, গুম, খুনের প্রতিশোধ গ্রহণের সুযোগ নিয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের শায়েস্তা করতে পারেন না। কত না ভালো হতো যদি বাংলাদেশেও এর প্রতিফলন ঘটত।
যুক্তরাষ্ট্রে এবং বিশেষ করে নিউইয়র্ক মহানগরীতে বাংলাদেশি ইমিগ্রান্টের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে সহজাত কারণেই বাংলাদেশের রাজনীতি এখানে প্রবলভাবে অনুভূত হয়, যা অন্য কোনো কমিউনিটিতে নেই বললেই চলে। এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি ইমিগ্রান্টদের সংখ্যা বৃদ্ধির ওপর সামান্য আলোকপাত করা যেতে পারে। বাঙালিদের যুক্তরাষ্ট্রে আগমনের সূচনা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে, যখন ভারতীয় উপমহাদেশ ব্রিটিশ শাসনাধীনে ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পর পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বাঙালিদের আগমনের হার বৃদ্ধি পায়। কিন্তু তা উল্লেখযোগ্য ছিল না। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর সত্তর ও আশির দশকে যুক্তরাষ্ট্রে বাঙালি আগমনের হার গড়ে বার্ষিক ১০ হাজার ছিল ধারণা করা হয়। এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে আগতদের অধিকাংশই ছিলেন ছাত্র ও পেশাজীবী। তারা মূলত শহরাঞ্চলে বসবাস করতে শুরু করেন, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাঙালি সমাবেশ ঘটে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ও জনবহুল অর্থনৈতিক কেন্দ্র নিউইয়র্কে। আশির দশকের শেষভাগ থেকে ডাইভারসিটি ইমিগ্রান্ট ভিসা প্রোগ্রামে বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার লোকজন যুক্তরাষ্ট্রমুখী হন এবং তাদের বড় অংশই আসেন নিউইয়র্কে। এর ফলে যেসব বাংলাদেশি যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন, তাদের দুই-তৃতীয়াংশের বসবাস নিউইয়র্কে।