
বাংলাদেশের রাজনৈতিক শাসন ও গণতান্ত্রিক দৃঢ়তা
একটি দেশের রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থা গঠিত হয় একটি শাসক কর্তৃপক্ষ, একটি প্রভাবশালী শ্রেণী বা শ্রেণীর জোট দ্বারা, যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হয় এবং আইন, নিয়ম-কানুন, কারাগার, পুলিশ, সেনাবাহিনী, আমলাতন্ত্র, বিশ্ববিদ্যালয়, থিংক ট্যাংক, ধর্ম, রাজনৈতিক দল, গণসংগঠন ইত্যাদির মতো সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জবরদস্তি বা/এবং আধিপত্যমূলক সম্মতি অর্জন ও টিকিয়ে রেখে তাদের রাজনৈতিক আধিপত্য বজায় রাখে। এ উপাদানগুলো সময়ের সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে বিবর্তিত হয়ে একটি দেশে গণতন্ত্রকে হয় উন্নত করতে পারে অথবা সামাজিক ন্যায্যতা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং এ প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলোয় অংশগ্রহণমূলক শাসনকে উৎসাহিত বা বাধাগ্রস্ত করে গণতন্ত্রকে হ্রাস করতে পারে। এখন আমি বাংলাদেশে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী দল এবং তাদের সংশ্লিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক বৈশিষ্ট্যগুলোর বিবর্তনের একটি খুব সাধারণ রূপরেখা আঁকব।
১৯৭১-৭৫: শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক শাসন
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে শাসনকারী রাজনৈতিক দল ছিল আওয়ামী লীগ (এএল)। এটি ছিল একটি বাঙালি জাতীয়তাবাদী দল, যার নেতৃত্বে ছিলেন জাতীয়তাবাদী নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি জাতির বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন পেয়েছিলেন। ধনী, দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত সবাই তাকে বঙ্গবন্ধু (বাংলাদেশের বন্ধু) বলে ডাকত!
আওয়ামী লীগ মূলত পাকিস্তানে আওয়ামী মুসলিম লীগ হিসেবে জন্ম নিয়েছিল এবং পরে নিজেকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নামে রূপান্তরিত করে। ১৯৭২-৭৫ সালে আওয়ামী লীগের শাসনের প্রধান সমালোচনাগুলো নিম্নরূপ—
ক. ১৯৭৪ সালে গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু বিরোধী দলগুলো কয়েকটি সংসদীয় আসনে কারচুপির অভিযোগ করেছিল।
খ. ১৯৭২ সালে বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় সরকার গঠনের দাবি জানিয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান এ প্রস্তাবে সম্মত হননি, যদিও আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় ব্যক্তি তাজউদ্দীন আহমদ, যিনি শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, এ প্রস্তাবের প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল ছিলেন বলে জানা যায়।
গ. পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সংসদে তাদের দাবি সত্ত্বেও কোনো সাংবিধানিক স্বীকৃতি পায়নি।
ঘ. ১৯৭৪ সালে প্রান্তিক ও দরিদ্র, বিশেষ করে কৃষি শ্রমিক শ্রেণী, সরবরাহ সংকট এবং ক্রয়ক্ষমতার হ্রাসের কারণে খাদ্য অধিকার চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। এ ফলে প্রান্তিক শ্রেণীর অনেক সদস্য দুর্ভিক্ষে মারা গিয়েছিল।
ঙ. আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিব প্রথমে বিরোধীদের প্রতিবাদ গণতান্ত্রিক উপায়ে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সংকট অব্যাহত থাকায় তিনি পরে একটি একদলীয় ব্যবস্থা গঠন করেন এবং ‘বাকশাল’ নামক দলের বাইরের সবার জন্য নাগরিক অধিকার সীমিত করে দেন।
চ. কিন্তু এটিই ছিল বাংলাদেশে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের শেষের শুরু।
১৯৭৫ সালে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য শেখ মুজিব ও তার পুরো পরিবারকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। খন্দকার মুশতাক ও ডানপন্থী আওয়ামী লীগারদের নেতৃত্বে একটি নতুন সরকার পুরনো সরকারকে প্রতিস্থাপন করে।
১৯৭৫-৯০: মুশতাক, জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদের রাজনৈতিক শাসন
এ সময়কাল ছিল সামরিক বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন ‘রাজার দল’ সৃষ্টির মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতার সম্পূর্ণ পুনর্গঠনের সময়। উদারনৈতিক গণতন্ত্র তখনো সূচিত হয়নি।
ক. শেখ মুজিবের হত্যার অল্প সময় পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে আওয়ামী লীগের চারজন বিশিষ্ট নেতার আরেকটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটে, যা তৎকালীন আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধপন্থী রাজনৈতিক নেতৃত্বকে কার্যকরভাবে পঙ্গু করে দেয়।
খ. খন্দকার মুশতাক, আওয়ামী লীগের আরেকজন ডানপন্থী আমেরিকাপন্থী নেতা, অল্প সময়ের জন্য ক্ষমতা গ্রহণ করেন। কিন্তু শিগগিরই সেনাবাহিনীর মধ্যে অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটে, যার ফলে সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান, যিনি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন, ক্ষমতায় আসেন। উচ্চাভিলাষী জেনারেল জিয়া সশস্ত্র বাহিনী এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শীর্ষ থেকে তার নিজস্ব রাজনৈতিক দল বিএনপি গঠন করেন। এটি একটি ডানপন্থী উদারনৈতিক দল।
গ. কিন্তু পরে জিয়াও একটি অভ্যুত্থানে নিহত হন এবং জেনারেল এরশাদ তার স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি প্রায় একইভাবে তার নিজস্ব জাতীয় পার্টি গঠন করেন। সময়ের সঙ্গে জাতীয় পার্টি আরো ডানপন্থী হয়ে ওঠে এবং ভারত-আমেরিকা অক্ষের সঙ্গে আরো শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তোলে।
ঘ. ১৯৯০ সালে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও অন্যান্য বামপন্থী রাজনৈতিক দলের জোটের নেতৃত্বে একটি গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেনারেল এরশাদের সেনা সমর্থিত শাসন উৎখাত হয়।
এই বিস্তৃত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সবচেয়ে অভিনব উদ্ভাবনী ফলাফল ছিল নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার নতুন প্রতিষ্ঠান।
১৯৯০-২০০৮: দ্বিদলীয় রাজনীতির যুগ
এই নতুন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ অন্যান্য অনেক দেশের মতো সফলভাবে একটি দ্বিদলীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে, যেখানে দুটি দল পর্যায়ক্রমে ক্ষমতায় আসতে ইচ্ছুক ও প্রস্তুত ছিল। উভয় দলই মূলত ধনী শ্রেণীর দ্বারা পরিচালিত হতো, যারা বিদেশী সাহায্য ব্যবহার করত বা বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে সুবিধা ভাগাভাগি করত এবং রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি ব্যবহার করে নিজেদের সমৃদ্ধ করত।
এ ধরনের অভিজাত স্বজনতোষণকারী ধনীদের দ্বারা চালিত সীমিত গণতন্ত্র কিছু সময়ের জন্য শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তন ছাড়াই স্থিতিশীল থাকতে পারে। কিন্তু যদি উভয় দলই পর্যাপ্ত সহনশীল এবং সভ্য না হয় তাহলে দ্বিদলীয় রাজনীতি কাজ নাও করতে পারে।
২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে চারটি জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে দ্বিদলীয় গণতন্ত্র বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল। এ নির্বাচনগুলোয় দুটি প্রধান অভিজাত নেতৃত্বাধীন দল—আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—প্রত্যেকে তাদের ক্লায়েন্ট নেটওয়ার্ক ‘বঙ্গভবন’ থেকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত ‘গ্রাম’ পর্যন্ত বিস্তৃত করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। নির্বাচনের মাধ্যমে চক্রাকারে শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন এ সময়ে সমাজের অসমতা এবং অন্যায়ের ওপর কোনো প্রভাব ফেলেনি, বরং তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছিল।