
ভারতের যুদ্ধে যাওয়া ও না-যাওয়ার বিপদ
সম্প্রতি ভারতের একজন সমরবিশেষজ্ঞ ও ফোর্স পত্রিকার সম্পাদক প্রবীণ সাহানি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন, কেন ভারতের পক্ষে এখনই যুদ্ধে যাওয়া সম্ভব নয়। তাঁর ও অন্যদের বক্তব্য থেকে একটা ন্যূনতম মৌলিক বিষয় বেরিয়ে আসছে। বিষয়টি হলো, ভারত এটা বুঝতে পারছে না যে আক্রমণ করে তারা শুধু পাকিস্তানের সঙ্গেই সরাসরি লড়াই করবে, নাকি চীনের সঙ্গে পরোক্ষভাবেও তাদের লড়তে হবে।
সাহানি বলেছেন, চীন পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ফলে চীন ও ভারতের সীমান্তে (লাইন অব অ্যাকচ্যুয়াল কন্ট্রোল বা এলএসি) চীনের সেনাবাহিনীর ‘গ্রে জোন অ্যাকটিভিটি’ (সরাসরি যুদ্ধে না গিয়ে এমন কিছু করা, যাতে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সফল হয়, আবার শত্রুপক্ষ বিষয়টিকে যুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত করে পাল্টা আক্রমণে যেতে পারে না। যেমন ভুয়া ও বিভ্রান্তিমূলক প্রচার চালানো, অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি, সাইবার আক্রমণ প্রভৃতি) বাড়াবে। এর ফলে চীন সীমান্ত, অর্থাৎ এলএসি থেকে যাবতীয় সরঞ্জাম (অস্ত্র ও লোকলস্কর) সরিয়ে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে (লাইন অব কন্ট্রোল) নিয়ে যাওয়ার বিষয় বিভ্রান্তিতে থাকবে ভারত।
সাহানির বক্তব্য, এই যুদ্ধ–পরিস্থিতিতে চীনের যে একটি অপ্রত্যক্ষ ভূমিকা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, তার প্রধান কারণ, ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদাবিষয়ক ধারাগুলোর প্রত্যাহার। এই পরিবর্তনের কারণে চীন ধারাবাহিকভাবে পাকিস্তানকে তাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছে।
চীন মর্যাদা প্রত্যাহারের বিষয়টি যে একেবারেই ভালোভাবে নেয়নি, সেটা তারা ২০১৯ সালের ৬ আগস্টই জানিয়েছিল। কারণ, কাশ্মীর চীন–সংলগ্ন অঞ্চল। এখানে কাশ্মীর নিয়ে ভারতের এককভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিরোধিতা করেছিল চীন। তাই কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ যদি একবার শুরু হয়, তবে চীন কোন পক্ষ নেবে, সেটা জোর দিয়ে ভারতের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করছেন, শুধু যদি পাকিস্তানের সঙ্গে লড়ার বিষয়ে ভারত নিশ্চিত হতো, তবে গত ২২ এপ্রিলের পরই তারা যুদ্ধ শুরু করে দিত।
চীনের পাশাপাশি ভারতের পূর্বে, অর্থাৎ বাংলাদেশ সীমান্ত নিয়ে ভারতের উদ্বেগ গত আট মাসে প্রচণ্ড বেড়েছে। এর সঙ্গে উত্তর-পূর্ব ভারতে চীন ছাড়াও রয়েছে মিয়ানমার সীমান্ত। যে সীমান্তের কারণে ভারতকে বড় ধরনের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। মণিপুরে আড়াই শতাধিক মানুষ মারা যাওয়ার পরে এবং সেখানেও নানান ‘অ্যাসেট’ (সরঞ্জাম) মজুত রাখতে হচ্ছে। পাকিস্তান সীমান্তের মতোই সেখান থেকেও চট করে সরঞ্জাম ও সৈন্য সরানো যাবে না।
যুদ্ধের খরচ
২০২১ সালে আফগানিস্তান ছাড়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয় ‘কস্ট অব ওয়ার’ বলে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে দেখিয়েছিল, ২০ বছরে খরচ হয়েছে ২ দশমিক ৩১ ট্রিলিয়ন ডলার (দৈনিক ৩১৬ মিলিয়ন ডলার)। এই হিসাব করা হয়েছিল, যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন বা আহত হয়েছেন, তাঁদের চিকিৎসার খরচ ও ক্ষতিপূরণ বাদ দিয়ে। যাবতীয় খরচ সুদসহ ধরলে ২০৫০ সালে এই অঙ্ক সাড়ে ৬ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে জানানো হয়েছিল।
ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া ঠিক কত খরচ করছে, তা জানা যায়নি। কারণ, মস্কো সবকিছু পার্লামেন্টে জানায় না। তারপরও রাশিয়া বিপদের মধ্যে রয়েছে বলে একাধিক আন্তর্জাতিক যুদ্ধ পর্যবেক্ষক সংস্থা মনে করছে। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পেন্টাগন জানিয়েছিল, দৈনিক ২৮৯ মিলিয়ন ডলার খরচ হচ্ছে প্রেসিডেন্ট পুতিনের।
এরই পাশাপাশি দিল্লিকে মাথায় রাখতে হচ্ছে যে এই সময়ে, যখন বিশ্বব্যাপী ‘রিসেশন’ বা মন্দার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, তখন ভারতের অর্থনীতি বেশ ভালো অবস্থায় রয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে বিশ্বব্যাংক বলেছে, বৃহৎ অর্থব্যবস্থার মধ্যে ভারতের সবচেয়ে দ্রুত হারে বৃদ্ধি হচ্ছে, চলতি আর্থিক বছরে সম্ভাব্য বৃদ্ধি ৭ শতাংশ। যুদ্ধ করে এই হার ধরে রাখা অসম্ভব। অন্যদিকে ভারত যাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারে, তাদের অবস্থা দেখে নেওয়া যাক।
- ট্যাগ:
- মতামত
- যুদ্ধ ও সংঘাত
- ভারত-পাকিস্তান