সংবাদপত্রের পাতায় প্রকাশিত কোনো কোনো শিরোনাম ও সংবাদ বিশেষ আগ্রহ নিয়ে পড়তে চান পাঠক। আজকের পত্রিকায় ৩১ মে প্রকাশিত প্রধান শিরোনাম, ‘৬ মাসের টানাটানিতে ভোট’ শীর্ষক সংবাদটি সম্পর্কে আমাকে একজন সম্পাদক ফোন করে প্রশংসা করলেন। আমি বুঝতে পারলাম শিরোনামটি যথেষ্ট প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। ভোট নিয়ে জনগণের আগ্রহ এবং ভোটে অংশগ্রহণ করার উৎসাহ দেশের মানুষের কাছে সব সময়ই ছিল এবং আছে। কিন্তু সাম্প্রতিক কালের ভোটের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য জনগণকে শুধু নিরুৎসাহিতই করেনি, বরং রাজনীতিবিমুখ হতে বাধ্য করেছে। উপরিউক্ত সংবাদটিতে রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন মহলের ভাবনার প্রতিচ্ছবি উন্মোচিত হয়েছে। বিএনপি বলছে ভোট ডিসেম্বরের মধ্যেই হতে হবে; সরকার আশ্বস্ত করেছে জুনের পর এক দিনও না। এই দোলাচলে দেশের জনগণ অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছে—কবে নাগাদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়?
১০ মাস। যেকোনো হিসাবেই ১০ মাস খুব সংক্ষিপ্ত সময় নয়। একজন মা অনেক কষ্ট আর যত্ন দিয়ে জন্ম দেন তাঁর শিশুটিকে। এই বিশ্বে অনেক শিশুর মতো ১০ মাসে একটি শিশু জন্মলাভ করে। নতুন আলোর মুখ দেখে। নতুন প্রত্যাশায় জন্ম নেয় প্রতিটি শিশু। দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে সময়। যে শিরোনামের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, তার মূল বিষয়টি হচ্ছে নির্বাচন।
‘মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগ নিয়ে আলোচনাসহ নানা ইস্যুতে সৃষ্ট অস্থির পরিস্থিতিতে গত মাসের মাঝামাঝিতে নড়েচড়ে বসে বিএনপিসহ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো। এ পরিস্থিতিতে ২৪ ও ২৫ মে বিএনপিসহ দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। এসব বৈঠকে অধিকাংশ দলের পক্ষ থেকেই নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা দিতে প্রধান উপদেষ্টাকে আহ্বান জানানো হয়। বিএনপি নির্বাচনের রোডম্যাপ, জামায়াত সংস্কার ও নির্বাচন, এনসিপির পক্ষ থেকে বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ দেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টাকে আহ্বান জানানো হয়।’
এই সংবাদ নিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন সেই সম্পাদক। এইসব মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, দেশের নির্বাচন সংশয়ের মুখোমুখি।
বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সংশয় ও উদ্বেগের পেছনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভিন্ন মতামত রয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল ও নিরপেক্ষতার প্রশ্নে দেখা যায়, ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়, ফলে বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যা অনেকের কাছে নিরপেক্ষতার অভাব হিসেবে দেখা যায়। অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে কি না, তা নিয়ে জনমনে গভীর সন্দেহ রয়েছে, পত্র-পত্রিকায় এসব মতামতের প্রকাশ ঘটেছে। দেখা যায়, বিগত নির্বাচনের বিতর্ক ও অংশগ্রহণের সীমাবদ্ধতাও একই কারণে। বিগত নির্বাচনে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছিল সীমিত, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণ ছিল খুবই কম। ভোট জালিয়াতি, পেশিশক্তির ব্যবহার এবং প্রশাসনিক পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ প্রসঙ্গক্রমেই উত্থাপিত হয়েছে। তাতে করে নির্বাচন নিয়ে জনগণের আস্থা হ্রাস পাওয়া স্বাভাবিক।
গত ২৮ মে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের আয়োজনে অনুষ্ঠিত তারুণ্যের সমাবেশে বলেন, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। তারেক রহমান বলেন, ‘আমরা ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশের জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তাই, জনগণের কাছে দায়বদ্ধ একটি সরকার দ্রুত দেখতে চাই।’ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি তিনি জোর দাবি জানান যে, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। তিনি নতুন প্রজন্মের ভাই-বোনদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে আপনারা জাতীয় নির্বাচন যাতে অনুষ্ঠিত হয়, তার প্রস্তুতি নিতে শুরু করুন।’
এদিকে সুশীল সমাজও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সংশয়ের মধ্যে রয়েছে। বর্তমান প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে তারা সন্দেহমুক্ত নয়। ভোটকেন্দ্রে নিরাপত্তা বাহিনীর আচরণ সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয় করছে বলে তারা মনে করে। অনেকে মনে করেন, নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করা উচিত। ভোটারদের মধ্যে অনেকে বিশ্বাস করেন, নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা এবং প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা যেমন জরুরি বিষয়, তেমনি রাজনৈতিক সহনশীলতা নিশ্চিত না হলে সুষ্ঠুভাবে জনমুখী নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়তো সম্ভব নয়।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে জনমনে সংশয় ও উদ্বেগ বিরাজ করছে, তা বলাই বাহুল্য। আমরা জানি, সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যকর অংশগ্রহণ যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রশাসনিক নিরপেক্ষতাও প্রয়োজন। নির্বাচনে স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করার জন্য দেশি ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও সম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে, তবে তাদের সিদ্ধান্তের ওপর সুষ্ঠু নির্বাচন যেন নির্ভরশীল না হয়ে পড়ে।