আর একদিন পরেই বাংলাদেশে ঈদুল আজহা পালিত হবে। মুসলমানদের দুটি বড় ধর্মীয় উৎসব হলো ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। ধর্মীয় উৎসব হলেও এ উৎসবগুলোর আমেজ থেকে অন্য ধর্মাবলম্বীদের বঞ্চিত করা হয় না। সব ধর্মেই বছরের কোনো না কোনো সময়ে এক বা একাধিক দিনে উৎসব পালনের রেওয়াজ রয়েছে। খ্রিষ্টান ধর্মে যিশু খ্রিষ্টের জন্মদিনটি পালিত হয় জাঁকজমকের সঙ্গে। খ্রিষ্টজগতে বড়দিনকে কেন্দ্র করে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এই উৎসবটিকে করে তুলেছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। যিশুখ্রিষ্টের জন্ম হয়েছিল বেথেলহেমের গোয়াল ঘরে ঘাস বিচালির মধ্যে। সেই যিশুখ্রিষ্টের জন্মদিন বার্লিনের পাঁচতারকা হোটেলে মহা উৎসবের মধ্যে পালিত হতে দেখে প্রখ্যাত লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী এক বিশাল বৈপরীত্য লক্ষ করেছিলেন। একইভাবে হিন্দু, বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মেও বেশকিছু ধর্মীয় উৎসব রয়েছে।
ইসলাম শুধু প্রার্থনার ধর্মই নয়, এতে রয়েছে উৎসবের আনন্দ। ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহা যতটা প্রার্থনার, ততটাই আনন্দ-উৎসবের। দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার পর আসে খুশির ঈদুল ফিতর। এই ঈদুল ফিতর নিয়ে কাজী নজরুল ইসলামের একটি অমর গান রয়েছে। ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখা গেলেই আমাদের বেতার ও সম্প্রচার মাধ্যমে বেজে ওঠে নজরুলের গানের কলি-ও মন রমজানেরই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ। এই ঈদে সাধ্যমতো নতুন কাপড় পরে পূতপবিত্র হয়ে ঈদের জামায়াতে শামিল হওয়া এ উৎসব দিনের নির্দিষ্ট প্রার্থনা। এরপর একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করে মুসলমানরা পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দের প্রকাশ ঘটায়। এই ঈদের প্রধান আকর্ষণ মিষ্টি, পায়েস দিয়ে আপ্যায়নে অংশগ্রহণ। বিশ্ববাজার সম্প্রসারিত হওয়ায় এখন বাংলাদেশের ঈদের উৎসবে আরবের খেজুর দিয়েও আপ্যায়নকে ইসলামি সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। ঈদুল ফিতরের আপ্যায়ন থেকে প্রতিবেশী বা বন্ধুস্থানীয় অন্য ধর্মের লোকরাও বঞ্চিত হয় না। ঈদুল ফিতরের অন্যতম ধর্মীয় বিধান হচ্ছে ফিতরা দেওয়া। ফিতরার এই নিয়ম দরিদ্রদের ঈদের আনন্দ উপভোগ করার সুযোগ দেয়। ইসলাম দরিদ্রজনের জন্য আন্তরিকতা বোধের সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
ঈদুল আজহা আসে ব্যতিক্রমধর্মী আনন্দের আমেজ নিয়ে। এই ঈদে হালাল পশু কুরবানি দেওয়ার রেওয়াজ চালু হয়েছে ইব্রাহিমের (আ.) আমল থেকে। ইসমাইল (আ.) ছিলেন ইব্রাহিম (আ.)-এর প্রাণপ্রিয় পুত্র। আল্লাহতায়ালা ইব্রাহিম (আ.)-কে স্বপ্নে নির্দেশ করলেন, তাঁর রাহে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বস্তুকে কুরবানি দিতে। ইব্রাহিম (আ.) গভীরভাবে ভেবেচিন্তে দেখলেন, তাঁর সবচেয়ে প্রিয় হলেন ইসমাইল (আ.)। তাঁকেই কুরবানি করতে হবে। ইব্রাহিম (আ.) বিষয়টি তাঁর প্রিয় পুত্রের কাছে খুলে বললেন। ইসমাইল (আ.) বিন্দুমাত্র আপত্তি করলেন না, ভীতও হলেন না। তাঁর অকৃত্রিম বিশ্বাস আল্লাহর ইচ্ছার কাছে সমর্পণ করাই শ্রেষ্ঠত্বের দরজা। নির্দিষ্ট দিনে পিতাপুত্র কুরবানিস্থলে উপস্থিত হলেন। ইব্রাহিম (আ.) নিজ প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.)-এর গলায় ছুরি চালিয়ে দেখলেন ইসমাইল (আ.) অক্ষত রয়েছেন। সে জায়গায় একটি দুম্বা কুরবানি হয়ে আছে। আল্লাহতায়ালা ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর ঈমান পরীক্ষা করেছিলেন মাত্র, অন্য কিছু নয়। দুজনেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। তাঁরা দুজনেই ইসলামের নবী। সেই থেকে ঈদুল আজহার দিনে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে হালাল পশু কুরবানি দেওয়ার রেওয়াজ চলে এসেছে। বিশ্ব মুসলিমজগতে এই দিনে কুরবানি দিয়ে এবং কুরবানির পশুর গোশত নিজেদের মধ্যকার দুর্বল ও দরিদ্রদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেওয়ার যে ত্যাগের আদর্শ সৃষ্টি করা হয়েছে, তা অব্যাহত থাকবে অনাগত দিনগুলোয়।
কুরবানির মধ্য দিয়ে আমরা মুসলমানরা পশু কুরবানি দিই। এই কুরবানি একটি প্রতীক মাত্র। এর আসল শিক্ষা মনের পশুকে কুরবানি দেওয়া। মানব মন অত্যন্ত দুর্বল। এই মনে অনেক সময় নিষিদ্ধ কাজকেও আকর্ষণীয় মনে হয়। এর ফলে মানুষ পাপের পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত হয়। মানুষকে তাই চেষ্টা করতে হয় রিপুর তাড়না থেকে মুক্ত থাকতে। রিপুর তাড়নাই হলো মনের পশু। এই তাড়নাকে জয় করতে পারলে মানুষ সত্যিকার অর্থে আশরাফুল মখলুকাত হয়ে উঠবে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন-মনের পশুরে করো জবাই/পশুরাও বাঁচে, বাঁচে সবাই। ঈদুল আজহার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হলো মনের পশুকে জবাই করা। মানুষ যখন পশুবৃত্তি থেকে মুক্ত হয়, তখন সে এক ভিন্ন মানুষে পরিণত হয়। সেই মানুষই পারে এই মর্তলোক স্বর্গের সুবাতাস দিয়ে ভরে তুলতে।