
ছাত্রসংসদ নির্বাচন নিয়ে অনাগ্রহ কেন
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৯ দফার অন্যতম দাবি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে লেজুড়ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা ও ছাত্রসংসদ চালু করা। এমনকি সমন্বয়কদের কেউ কেউ বলছেন, আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদ নির্বাচন, পরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কিন্তু কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় উদ্যোগের ব্যবস্থা নিলেও বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন ছাত্রসংসদের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বলে মনে হচ্ছে। অনেক উপাচার্য বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন, যে কারণে তাঁরা কমিটি করছেন ছাত্রসংসদ নির্বাচন বাস্তবায়ন করার জন্য।
নেতৃত্বের সূতিকাগার বা আঁতুড়ঘর হলো ছাত্রসংসদ, যার মাধ্যমে সঠিক নেতৃত্ব বের হয়ে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদ নেতৃত্ব তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই ছাত্রসংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে সত্যিকার নেতা বের হয়ে আসেন, যদি নির্বাচন সঠিক ও সময়মতো হয়। কিন্তু কেন জানি আমরা ছাত্রসংসদ নির্বাচনের বিষয়ে আগ্রহ দেখাই না।
অতীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা এ বিষয়ে তেমন কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেননি। অনেকের ধারণা, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রসংসদ নির্বাচন দিতে ভয় পায়। অনেক বড় বিশ্ববিদ্যালয়েও ২০ থেকে ৩০ বছর ধরে ছাত্রসংসদ নির্বাচন হয়নি। বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) সর্বশেষ ২০১৯ সালে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯২ সালে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯০ সালে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮৯ সালে, বুয়েটে ২০০১ সালে, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯৮ সালে এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯৭ সালে ছাত্রসংসদ নির্বাচন হয়েছে।
(উৎস : কালের কণ্ঠ, ১৮ এপ্রিল ২০২৫)
তবে ঢাবির ২০১৯ সালের ছাত্রসংসদ নির্বাচনে যাঁরা নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। তার পরও ওই নির্বাচনের মাধ্যমে ভিপি নুর নির্বাচিত হয়ে রাজনীতিবিদ বা নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। কিন্তু ওই নির্বাচন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদ্যোগে হয়নি, হয়েছে আদালতের নির্দেশ কার্যকর করার জন্য। এর পর থেকে আবার ছাত্রসংসদ নির্বাচন বন্ধ রয়েছে।
দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এখন পর্যন্ত শুধু জাহাঙ্গীরনগর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রসংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে।
আর গত মঙ্গলবার ১৫ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ডাকসু নির্বাচনের টাইমলাইন ঘোষণা করে, যা ইতিবাচক। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আইন অনুযায়ী পরিচালনার জন্য ছাত্রসংসদ নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজগুলোতেও ছাত্রসংসদ নির্বাচন হচ্ছে না।
তবে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের বিষয়ে কোনো কথা নেই। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ছাত্রসংসদ থাকা বাধ্যতামূলক এবং সময়মতো নির্বাচন হওয়া জরুরি। কারণ ভবিষ্যতে দেশ পরিচালনার জন্য নেতৃত্বের প্রয়োজন হবে। এর জন্য দরকার ছাত্রসংসদ নির্বাচন।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হল সংসদের নির্বাচনও বন্ধ রয়েছে। ছাত্রসংসদ না থাকার কারণে সংগঠনগুলো তার গতি হারাতে বসেছে। ছাত্রদের অধিকারগুলো নিয়ে কেউ তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। ছাত্রসংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে পেশিশক্তির রাজনীতি বন্ধ করা সম্ভব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদ ডাকসু জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম এবং একাত্তর-পরবর্তী যেকোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ব্যাপক ও কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে ছাত্রসংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা ৫০ বার, সেখানে নির্বাচন হয়েছে মাত্র আটবার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনেক রকমের নির্বাচন হয়ে থাকে; যেমন—শিক্ষক সমিতি নির্বাচন, কর্মচারী নির্বাচন। কিন্তু ছাত্রসংসদ নির্বাচন হয় না। এখানে নানা ধরনের প্রশ্ন সৃষ্টি হয়। এই নির্বাচন না হওয়ার পেছনে প্রশাসনের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে মনে হয়। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন উদ্যোগ নিলে প্রতিবছর ছাত্রসংসদ নির্বাচন বাস্তবায়ন করা সম্ভব। ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচনের নেতৃত্ব শিক্ষার্থীদের অধিকার বা দাবি আদায়ে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। কারণ নানা রকম সমস্যা ছিল। সব সরকারের আমলে ছাত্রসংসদ নির্বাচন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের গড়িমসি ছিল বলে অভিযোগ আছে। ছাত্রসংসদ এমন একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে নেতৃত্ব সৃষ্টি হয় এবং ছাত্রদের অধিকার আদায়ের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটে কোনো ছাত্র প্রতিনিধিও নেই। ফলে ছাত্রদের অধিকার নিয়ে সিনেটে কথা বলার লোক নেই।
- ট্যাগ:
- মতামত
- ছাত্র সংসদ নির্বাচন