
শুল্কযুদ্ধের বৈশ্বিক প্রভাব ও বাংলাদেশ
বিশ্ব অর্থনীতিতে এই মুহূর্তে সবচেয়ে আলোচিত প্রসঙ্গ হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আমদানি পণ্যে অতিরিক্ত হারে শুল্কারোপ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দায়িত্ব গ্রহণের পর দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ভারসাম্য অনুকূলে ফিরিয়ে আনার জন্য নানা উদ্যোগ নিতে শুরু করেন। ট্রাম্প একজন ব্যবসায়ী। আগেরবার ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি গ্রহণ করেছিলেন।
উদ্দেশ্য ছিল সব ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্য নিশ্চিত করা। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি বিগত ৪০ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করে ৯.১ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। চীন এবং আরো কিছু দেশের তৈরি পণ্যের ব্যাপক উপস্থিতির কারণে স্থানীয়ভাবে উত্পাদিত মার্কিন পণ্য বাজারে মার খাচ্ছে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব আমেরিকা (ফেড) বারবার পলিসি রেট বৃদ্ধি করেছে। ফলে দেশটিতে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগে স্থবিরতার লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
এই পরিস্থিতিতে আমদানি পণ্যের ওপর অস্বাভাবিক উচ্চমাত্রায় শুল্ক আরোপ করা হলো কেন সে সম্পর্কে কোনো পরিষ্কার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। তবে অনেকেই মনে করছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে সম্ভাব্য বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার জন্য ট্রাম্প প্রশাসন বিভিন্ন দেশের আমদানি পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছে।
আর এমন সব দেশের আমদানি পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, যাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ভারসাম্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিকূলে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৬০টি দেশের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করেছে। সংশ্লিষ্ট দেশগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানিকালে যেসব পণ্যের ওপর সর্বোচ্চ শুল্ক আরোপ করে, তাকে ভিত্তি ধরে তার অর্ধেক হারে বর্ধিত শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। গড় শুল্কহারকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
যেমন—বাংলাদেশের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যেতে পারে। বাংলাদেশ কোনো কোনো মার্কিন পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ৭৪ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করে থাকে। কিন্তু সাধারণভাবে বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে গড়ে ১৫-১৬ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করে। তবে দ্বিপক্ষীয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের মধ্যে অন্যতম। বর্তমানে বাংলাদেশ-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে বাংলাদেশের অনুকূলে বাণিজ্য উদ্বৃত্তের পরিমাণ হচ্ছে ৬.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ প্রতিবছর গড়ে ৮.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে থাকে। তিন দশক আগে অর্থাত্ ১৯৯১-৯২ অর্থবছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা কোনো কোনো পণ্যের ওপর বাংলাদেশ প্রায় ৭১ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করেছিল। কাজেই বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ বাড়তি শুল্কারোপ কোনোভাবেই সংগত নয়। ট্রাম্প প্রশাসন চীন বাদে অন্য দেশগুলোর আমদানি পণ্যের ওপর ধার্যকৃত বাড়তি শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত করেছে। উপরন্তু চীনা পণ্যের ওপর আরোপিত বাড়তি শুল্কের হার বাড়িয়ে ২৪৫ শতাংশ করা হয়েছে। এর আগে চীনা পণ্যের ওপর ৩৪ শতাংশ হারে বর্ধিত শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল। এর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে চীন মার্কিন পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ১২৫ শতাংশ শুল্কারোপের ঘোষণা দিয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই বর্ধিত শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক. তা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হতেই পারে। এ ধরনের শুল্কারোপ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতিমালার সঙ্গে কতটা সংগতিপূর্ণ, তা বিবেচনার দাবি রাখে। এই বাড়তি শুল্কারোপ বাস্তবায়িত হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশের জন্য লাওসের পণ্যকে ৪৮ শতাংশ হারে শুল্ক প্রদান করতে হবে। ভিয়েতনামকে ৪৬, শ্রীলঙ্কাকে ৪৪, মায়ানমারকে ৪৪, বাংলাদেশকে ৩৭, পাকিস্তানকে ২৯, ভারতকে ২৬, দক্ষিণ কোরিয়াকে ২৫, মালয়েশিয়া ও জাপানকে ২৪ করে, ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ২০ এবং ইসরায়েলকে ১৭ শতাংশ বাড়তি শুল্ক দিতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাড়তি শুল্কারোপের ক্ষেত্রে করের হারে কিছুটা তারতম্য করলেও কোনো দেশকেই ছাড় দেয়নি। এমনকি ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলও বাদ পড়েনি। ভারত সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু মনে করে। দেশটি হয়তো আশা করেছিল, ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে তারা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা পাবে, কিন্তু তাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। ভারতের বিরোধী দলের নেতা ও পার্লামেন্ট সদস্য পি চিদাম্বরম এক সাক্ষাত্কারে বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি ভারতীয় পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করে, তাহলে আগামী ছয় মাসের মধ্যে ভারতীয় অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমদানি করা সব ধরনের গাড়ির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা ২ এপ্রিল থেকে কার্যকর হয়েছে। এতে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতি হতে পারে। ভারতে উত্পাদিত গাড়ির এক-পঞ্চমাংশই আসে রপ্তানি থেকে। এর মধ্যে ২৭ শতাংশই আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এটি শুধু গাড়িশিল্পের ক্ষতির পরিসংখ্যান—সাধারণভাবে বর্ধিত শুল্কারোপের যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তার প্রতিক্রিয়া কতটা হবে, সেটি এই মুহূর্তে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বৈদেশিক বাণিজ্য নীতি
- শুল্ক আরোপ