
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে
‘স্বাধীনতা’ একটি জাতির জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং কাঙ্ক্ষিতও বটে। কোনো মর্যাদাবান জাতি কখনোই স্বাধীনতাহীনতায় বেঁচে থাকতে চায় না। মানুষ তো বটেই, প্রতিটি প্রাণীই স্বাধীনতাপ্রিয়। কিন্তু স্বাধীনতা এমনই এক বস্তু, যা চাইলেই পাওয়া যায় না। অনেক ক্ষেত্রে স্বাধীনতার জন্য জীবন বিসর্জন দিতে হয়।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষ এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনেছিল। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ তাৎক্ষণিক কোনো ঘটনার ফল নয়, তেমনি কারও দয়ার দানও নয়। বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘদিনের চাওয়ার সফল পরিণতিই হচ্ছে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ। এদেশের মানুষকে একসময় ভীতু বাঙালি বলে উপহাস করা হতো। কিন্তু এ অঞ্চলের মানুষ বারবার প্রমাণ করেছে, তারা ভীতু নয়; বরং অন্য যে কোনো দেশের মানুষের চেয়ে সাহসী ও স্বাধীনতাপ্রিয়।
তারা মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য জীবন দিতেও যে কার্পণ্য করে না, বারবার এটি প্রমাণ করেছে। মাঝেমধ্যেই স্বাধীনতা বিপন্ন হওয়ার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। কথায় বলে, স্বাধীনতা অর্জন করা যত কঠিন, স্বাধীনতা রক্ষা করা তার চেয়েও বেশি কঠিন। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে স্বাধীনতা বিপন্ন হতে পারে। স্বাধীনতা বিপন্ন হওয়ার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে দেশের মানুষকে জীবন দিয়ে হলেও স্বাধীনতা রক্ষা করতে হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা বারবার বিপন্নের মুখোমুখি হয়েছে এবং প্রতিবারই জীবনের বিনিময়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা হয়েছে। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে স্বৈরাচারী সরকারের ১৫ বছরের অবৈধ শাসনের অবসান ঘটেছে।
এজন্য বিপুলসংখ্যক মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। ১৯৭১ সালের ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যতসংখ্যক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, তারপর স্বাধীন দেশে আর কখনোই ৫ আগস্টের মতো এত বিপুলসংখ্যক মানুষকে প্রাণ দিতে হয়নি। বাংলাদেশ যতদিন টিকে থাকবে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জনের গৌরব ততদিন টিকে থাকবে। ঠিক একইভাবে স্বৈরাচারবিরোধী সফল আন্দোলনের ইতিহাসে ৫ আগস্টের অর্জিত বিজয়গাথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ অথবা ১৬ ডিসেম্বের সঙ্গে ৫ আগস্টের কোনো বিরোধ নেই। কিন্তু কোনো কোনো মহল থেকে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা অর্জন এবং ৫ আগস্টের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাফল্যকে সুকৌশলে মুখোমুখি দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, ৫ আগস্ট হচ্ছে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’। অন্যপক্ষ বলছে, স্বাধীনতা একবারই আসে, যা আমরা ১৯৭১ সালে অর্জন করেছি, ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলে কিছু নেই। যারা ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং বিজয় দেখেনি, তারাই ৫ আগস্টের বিজয়কে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ হিসাবে আখ্যায়িত করছে।
আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে মনে করি, উভয় বক্তব্যের মধ্যে অতিরঞ্জন ও আবেগ কাজ করছে। ইস্যুটি নির্মোহভাবে আলোচনা করা যেতে পারে। প্রথমেই ব্যাখ্যা করা যাক ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলে কিছু নেই এ কথাটির। স্বাধীনতা বলতে আমরা কী বুঝি? একটি জনপদ যখন বিদেশি শক্তির দ্বারা পরাভূত ও অধিকৃত হয়, তখন সেই অবস্থাকে স্বাধীনতা হরণ বা পরাধীনতা বলা হয়। মর্যাদাবান জাতি কখনোই তাদের নিজ মাতৃভূমির স্বাধীনতাকে বিদেশি শক্তির হাতে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চুপ বসে থাকতে পারে না।
কোনো দেশ একবারই বিদেশি শক্তি দ্বারা পরাভূত ও অধিকৃত হবে এমন কোনো কথা নেই। একটি দেশ একাধিকবার পরাজিত হতে পারে এবং বারবার পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙতে পারে। কাজেই ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলে কোনো কিছু নেই, কথাটি সর্বাংশে সত্যি নয়।
বাংলাদেশ বারবার স্বাধীনতা হারিয়েছে এবং বারবারই হৃত স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করেছে। স্বাধীনতা দুভাবে অর্জিত হতে পারে। প্রথমত, স্বাধীনতা হরণকারী গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে স্বাধীনতা ফিরে পাওয়া যেতে পারে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে ১৯৪৭ সালের পাকিস্তান ও ভারত স্বাধীন হওয়ার ঘটনাটি।