
নির্বাচন কি ঈদ উৎসবের মতো আনন্দময় হয়ে উঠবে
যে রকম পরিস্থিতিতে দেশ চলছে, তাতে দেশের জনগণের স্বস্তিতে থাকার কোনো কারণ নেই। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ৫ আগস্ট নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ায় সেই অস্বস্তি থেকে বের হয়ে আসার আপাতত একটা পথের দিশা পাওয়া গেল। জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা এই ভাষণ দেওয়ার আগে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা থেকে জুলাই ঘোষণাপত্রও পাঠ করেছেন। গণ-অভ্যুত্থানের বছর পূর্তির দিনে এমন কিছু ঘটনাও ঘটেছে, যা ভবিষ্যৎ সংঘাতের ইঙ্গিত দেয়।
প্রধান উপদেষ্টা ভাষণ দেন ভালো। ভাষণে যে কথাগুলো বলা হয়, তাও উচ্চারণ করা হয় খুবই স্বাভাবিকভাবে। তিনি যখন নির্বাচনকে ঈদের উৎসবের মতো আনন্দময় করে তোলার আহ্বান জানান, তখন সবার মনই আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠার কথা। কিন্তু এই ‘আনন্দ’ কি সবার জন্য হবে, নাকি নির্দিষ্ট একশ্রেণির মানুষের জন্য হবে, সেটা প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ থেকে স্পষ্ট হয়নি। ‘সবার’ বলতে কি তিনি দেশের আপামর জনসাধারণের কথা বলছেন, নাকি গণ-অভ্যুত্থানের ফলে যারা বিজয়ী হয়েছে, শুধু তাদের কথা বলছেন, সেটা পরিষ্কার হয়নি। এই বিষয়টি নিয়ে ভবিষ্যতে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হবে বলে মনে হয়।
যে জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করেছেন তিনি, তাতে রয়েছে অনেক অসম্পূর্ণতা। গণ-অভ্যুত্থানে বিজয়ী হয়েছে যারা, তাদের খুশি করার চেষ্টা আছে তাতে, কিন্তু সেটা করতে গিয়ে দেশের ইতিহাসের অনেক উল্লেখযোগ্য দিক এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন। যেভাবে আমাদের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে, তা খুবই দুর্বল। স্বাধীনতাযুদ্ধের মূল নায়ক শেখ মুজিবকে এড়িয়ে যাওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করা হয়েছে। ঘোষণাপত্রে আওয়ামী লীগের বিগত শাসনামলের কড়া সমালোচনা থাকলেও স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মিলে প্রত্যক্ষভাবে হত্যাযজ্ঞে শরিক হয়েছিল যে জামায়াতে ইসলামী, তাদের ভূমিকা নিয়ে কোনো কথা নেই। নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীর ও মানবজমিন পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী চ্যানেল আইয়ের ‘আজকের সংবাদপত্র’ অনুষ্ঠানে সে বিষয়গুলো স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন। সামনের নির্বাচনটি যে উত্তেজিত হয়ে থাকা বিভিন্ন দলের মধ্যে সংঘাত-দ্বন্দ্বের জন্ম দিতে পারে, সে আশঙ্কার প্রকাশও দেখা গেছে। ফলে, নির্বাচনের সময় সবার জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করার সক্ষমতা না থাকলে নির্বাচনটিতে ঈদের আনন্দ থাকবে বলে মনে হয় না। সে পরিবেশ সৃষ্টি করার দিকেই দৃষ্টি রাখা দরকার।
বলে রাখা ভালো, একটি গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা সরকারের কাছে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনই আশা করে জনগণ। আওয়ামী লীগ সরকার পরপর তিনটি নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করেনি বলেই তো তাদের ব্যাপারে ছিল সমালোচনা। তার বিপরীতে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান করা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। প্রাপ্তবয়স্ক প্রতিটি মানুষ যেন নিজের ভোটটি নিজে দিতে পারেন, সে ব্যবস্থা থাকতে হবে। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহল এই দিকটাতে নজর রাখবে। পান থেকে চুন খসলেই তা অনেক বড় আকারে দৃশ্যমান হবে। সুতরাং সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচনের চ্যালেঞ্জটি এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন বলতে আসলে কী বোঝায়, সে কথাটিও স্পষ্ট করা দরকার। বিভিন্ন টেলিভিশনের টক শোতে কিংবা সংবাদপত্রের কলামে নির্বাচন নিয়ে নানা কথা হয়। তার একটি হলো, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনের মাঠে লড়াই করতে দেওয়া না হলে সে নির্বাচনকে কি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন বলা যাবে? অনেকেই বলে থাকেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে যেসব অন্যায় করেছে, তার জবাব তো ব্যালটেই দেবে মানুষ। সাধারণ মানুষের কাছে আওয়ামী লীগের গ্রহণযোগ্যতা কতটা, সেটা সাধারণ মানুষই জানিয়ে দিক। অন্যদিকে কেউ কেউ মনে করে থাকেন, আওয়ামী লীগ যেহেতু ভোটের অধিকার হরণ করেছিল, তাই এ মুহূর্তে তাদের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। এইসব আলোচনা-সমালোচনা থেকে যে প্রশ্নটি উঠে আসে, তা হলো, যাঁরা আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টিকে সমর্থন করেন, তাঁরা কি প্রধান উপদেষ্টার বলা ‘সবাই’-এর অন্তর্ভুক্ত, নাকি তাঁরা এই তালিকার বাইরে থাকবেন? দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না দিলে ভবিষ্যতে তা নিয়ে কি সমালোচনা হবে না? জামায়াতে ইসলামীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেয়নি আওয়ামী লীগ, এ নিয়ে কত সমালোচনা করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে যদি এই সরকার একই আচরণ করে, তাহলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে এই সরকারের পার্থক্য কী?