গত ৫ আগস্ট ছিল সাড়ে ১৫ বছরের আওয়ামী দুঃশাসনের অবসানের দিন। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন। সত্যি বলতে কী, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান তো হওয়ারই ছিল। কেননা, মানুষের মনে ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ দানা বাঁধতে বাঁধতে একসময় বিস্ফোরিত হবে, এটাই তো স্বাভাবিক। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার তাদের দুঃশাসনের রক্তচক্ষু দেখিয়ে যেভাবে লুটপাট করে যাচ্ছিল, বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ করে মানবাধিকার হরণ করে যাচ্ছিল, এভাবে চলতে থাকলে একসময় পুরো জাতিই অন্ধকারে নিমজ্জিত হতো। দেশ অনেকটাই পিছিয়ে পড়ত। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জাতি এর থেকে মুক্তি পেয়েছে। সাড়ে পনেরো বছরে দেশের গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, মানবাধিকার সবকিছুই তো আমরা খুইয়ে বসেছিলাম। ভাবতে অবাক লাগে, নির্বাচন ছাড়া একটা সরকার সাড়ে পনেরো বছর ক্ষমতায় টিকে থাকল কিভাবে। একটা স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশে এটাও কি সম্ভব? ওই সরকারের সবকিছুই জনগণ মুখ বুজে সহ্য করেছে। সহ্য করেছে বললে ভুল হবে, সহ্য করতে বাধ্য করা হয়েছে।
দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাটিকে ধ্বংস করা হয়েছে তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপের মাধ্যমে। যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটা থাকত, তাহলে জুলাই অভ্যুত্থানের প্রয়োজন হতো না। দেশের অবস্থা ভালো থাকত। যে সরকারই ক্ষমতায় থাক না কেন, দেশের পরিস্থিতি এতটা অসহিষ্ণু হতো না। এমনকি যিনি পালিয়ে গেছেন, তিনিও যদি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকতেন, তাহলে তাকে পালাতে হতো না। তখন সবাই বলত, তিনি তো নির্বাচিত সরকার। এখন দেশের জনগণ তো এটা স্বীকারই করে না যে, আওয়ামী লীগ সরকার বৈধ ছিল। কারণ, তারা নির্বাচিত ছিল না। আর এটিই শেখ হাসিনা সরকারের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের নেতাকর্মীদের বোঝা উচিত ছিল, নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার মানে হচ্ছে অন্যদের নির্বাচন থেকে দূরে রাখা। সুতরাং অন্যদের দূরে রেখে নির্বাচন দিলে সেটা যে গ্রহণযোগ্য হবে না এটাই স্বাভাবিক। আর সেটাই হচ্ছে মূল সমস্যা।
এখন বৈষম্য আর কোটার বিষয়টিতে আসি। পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ কি আছে, যেখানে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম হয়েছে এবং যুগের পর যুগ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নাতি-পুতিদের জন্য কোটা বরাদ্দ রাখা হয়েছে? বিশ্বে এমন একটি দেশও কি আছে? না, আমি আমার জীবদ্দশায় কোথাও দেখিনি। ৪০ শতাংশ মেধা বা মেরিট কোটা রেখে বাকি ৬০ শতাংশই যদি বিভিন্ন কায়দায় অন্য কোটায় নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে মেরিটের তো কোনো দামই থাকল না। যে সমাজ মেরিটের দাম দেয় না, সে সমাজ কখনো এগোতে পারে না। কারণ একজন মেধাবীর কাছ থেকে সৃষ্টিশীল কিছু না কিছু আসবেই, যেটা দেশ ও জাতির জন্য প্রয়োজন। এ বিষয়টি আমাদের দেশের রাজনীতিকদের মাথায় কেন আসে না? আর এ বিষয়টি নিয়ে ছাত্রদের দাবিই বা করতে হবে কেন, আন্দোলনেই বা নামতে হবে কেন? এটা তো সরকারের মধ্যে যেসব রাজনীতিকরা ছিলেন তাদের বোঝা উচিত ছিল, এমনকি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীরও বোঝা উচিত ছিল। তাদের ধারণা, মুক্তিযুদ্ধের নাতি-পুতিদের সাহায্যের জন্য কোটা প্রয়োজন।
বর্তমান সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত নাতি-পুতি কি আর আছে! কথার কথা বলছি, একজন মুক্তিযোদ্ধা যদি স্বাধীনতাবিরোধী কোনো ব্যক্তির মেয়েকে ছেলের বউ হিসাবে ঘরে আনে, তাদের ঘরে যে নাতি-পুতিরা আসবে, তাদেরকে কি মুক্তিযোদ্ধার নাতি-পুতি বলবেন, নাকি স্বাধীনতাবিরোধীর নাতি-পুতি বলবেন? এতে করে কি নাতি-পুতিরা মুক্তিযোদ্ধা আর স্বাধীনতাবিরোধীর মধ্যে মিশে যায় না? তাহলে কাদেরকে এ কোটার মাধ্যমে সাহায্য করতে চাওয়া হচ্ছিল? কারণ, যাদের স্বাধীনতাবিরোধী বলা হচ্ছিল, তাদেরও তো মেয়ে বা ছেলের মুক্তিযোদ্ধার ছেলে বা মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে। তাহলে মুক্তিযোদ্ধার মূল্যায়নটা কীভাবে করা হবে? এটা নিয়ে অযথাই বাড়াবাড়ি হয়েছে। মাঝখান থেকে কতগুলো রক্ত ঝরল। কতগুলো তাজা প্রাণ চলে গেল আমাদের ছেড়ে। অনেক মেধাবী ছাত্রছাত্রীকে হারাতে হলো আমাদের। এ বিষয়টিকে দেশের একজন প্রধানমন্ত্রীর বহু আগেই শেষ করে দেওয়া উচিত ছিল। তা না করে তিনি এগুলোর পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছেন, এ ব্যাপারে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন, যেটা দেশের একজন প্রধানমন্ত্রীর কাছে আশা করা যায় না। ২০১৮ সালে ছাত্রছাত্রীরা যখন কোটা নিয়ে আন্দোলন করেছে, তখনই এর একটি চূড়ান্ত মীমাংসা করা উচিত ছিল তার। বরং তিনি উলটোটি করেছেন।
যা হোক, জুলাই আন্দোলনে এত লোকের আত্মাহুতি, এত লোক শহীদ হলো, এদের ভুলে গেলে চলবে না। এদের কারণেই আজ আমরা মানবাধিকার ফিরে পেয়েছি। তাদের জন্যই সাংবাদিকরা আজ স্বাধীনভাবে তাদের কলম চালাতে পারছেন। গুম-খুনের ভয়াবহ সংস্কৃতি থেকে দেশ বের হতে পেরেছে। জাতি বিভেদের সংস্কৃতি থেকে বের হতে পেরেছে। দেশের মানুষের এক ভাগকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাপন্থি, আরেক ভাগকে চেতনাবিরোধী বলা-এ বলয় থেকে আমাদের পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে হবে। এটাই হচ্ছে জুলাই আন্দোলনের মর্ম। ছাত্র-জনতার যে আত্মত্যাগ, সেটা আমরা যেন ভুলে না যাই। আবু সাঈদ, মুগ্ধ-এ রকম হাজারো মানুষ যারা আত্মত্যাগ করেছেন, তাদের যেন জাতি ভুলে না যায়। তাদের আত্মত্যাগের সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনা হয় না। যেখানে পুরো জাতি আশাই ছেড়ে দিয়েছিল, হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছিল, সেখানে ছাত্ররা আলোর মুখ দেখিয়েছে। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে জনতাও তাদের সঙ্গে একত্র হয়েছে। প্রত্যেকেই মন থেকে ফ্যাসিস্ট সরকারের অত্যাচার, অবিচার, বৈষম্যের বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু তারা সাহস করে তা প্রকাশ করতে সক্ষম হচ্ছিল না। যখন ছাত্ররা মাঠে নেমেছে, তখনই জনতাও নেমেছে। স্কুল, কলেজ, পাবলিক ও প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি, মাদ্রাসা, সব জনপদের লোক একত্র হয়েছে। কারণ একটাই-স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি।