গণ-অভ্যুত্থানে শ্রমিক আকাঙ্ক্ষা: সমাজ ও সংস্কৃতিতে শ্রমিক সুরত
বাধা ডিঙিয়ে হয় না পাখা মেলা
জন্ম থেকেই জোটে না কানাকড়ি সময়ও
তবু প্রতিক্ষণে তোমায় ক্ষুদ্র-তুচ্ছ ভাবায় তারা।
আপসে মেনে নেওয়া যেন নিয়তি তোমার।
যতক্ষণ ওই নিষ্ঠুর চাপানো নিয়তির তীব্র যন্ত্রণা কুরে কুরে না খায়
যতক্ষণ না তা অসহনীয় হয়ে ওঠে
ততক্ষণ যেন তা তোমার গায়ে সয়ে রয়
একজন শ্রমিকশ্রেণির নায়ক হওয়া সহজ কথা নয়
একজন শ্রমিকশ্রেণির নায়ক হওয়া সহজ কথা নয়
[জন লেনন (১৯৪০-১৯৮০)–এর ‘শ্রমিকশ্রেণির নায়ক’ গানের ভাবালম্বনে]
১
সমাজে শ্রম কিংবা শ্রমিকের জীবনের মূল্য কত? তার পরিমাপ বা চিত্রায়ণ হয় কীরূপে? সেই ভাবনায় জন লেননের কালজয়ী গান ‘শ্রমিকশ্রেণির নায়ক’–এর কথা মনে পড়ে। গানে গানে যুক্তরাজ্যের কবি–চিত্রশিল্পী–লেখক-গায়ক-সংগঠক জন লেনন শ্রমিকের পরিচয় সম্পর্কে বলেন, ‘জন্মের পর থেকেই…প্রতিক্ষণে তোমায় ক্ষুদ্র-তুচ্ছ ভাবায় তারা।’ মনে পড়ে রোকেয়া সাখাওয়াতের লেখা ‘সুলতানার স্বপ্ন’ প্রবন্ধের লাইন, ‘শিখিবার পূর্বেই আমাদের ডানা কাটিয়া লওয়া হয়।’ রোকেয়া সাখাওয়াত যদিও নারীদের অবস্থা নিয়ে কথাগুলো বলেছিলেন, কিন্তু এ কথা সব নারী–পুরুষ শ্রমিকের বেলায় সমান প্রযোজ্য। এমনই সেকাল-একালে সময় যত গড়ায়, নতুন এ জমানার নারী ও পুরুষ শ্রমিক যেন আধুনিক দাসের লেবাসে পর্দায় পা রাখেন। এ বিষয়ে সমাজের ওপরতলা থেকে খোদ শ্রমজীবীদের বাহাস-লড়াই ইতিহাসে কালে কালে চলমান থাকে। কখনো কোনো বিশেষ ঐতিহাসিক দিনে, আন্দোলনমুখর মুহূর্তে কিংবা কোনো মাহেন্দ্রক্ষণে এ আলাপ ওঠে তুঙ্গে। ‘জুলাই ২০২৪ গণ-অভ্যুত্থান’ আমাদের সেই রকম ক্ষণে হাজির করেছে। তাই এ যাত্রায় লড়াইয়ের ময়দানে, পুলিশের লাঠি-বারুদ-কাঁদানে গ্যাসের শেল কিংবা বন্দুকের নলের মুখে, মন্ত্রণালয়ের টেবিলে, জুলাই–পরবর্তী নানা সংস্কার কমিশনে অথবা দেশি–বিদেশি সরকার-মালিকদের নির্দেশনামা-পরিকল্পনা-রোডম্যাপে কিংবা সুধী সমাজের গবেষণা-সভা-সেমিনারে জাতীয় অর্থনীতির গতিপ্রকৃতির আলাপে শ্রমিক কল্যাণ প্রশ্নের ঠাঁই জুটেছে।
এটাকে কেউ কেউ ইতিহাসের দায় মেটানোর ও পাকাপোক্ত জবাবদিহির কাঠামো তৈরির সুযোগ বলেও চিহ্নিত করতে পারেন। একই সঙ্গে চিহ্নিত করতে পারেন চব্বিশ গণ-অভ্যুত্থানের শিক্ষার্থী-শ্রমজীবী, নারী-শিশুর জীবনের বিনিময়ে পাওয়া এক সুবর্ণরেখায়। সন্দেহ নেই, এই রেখা বাংলাদেশের জনগণের জন্য এক বিশেষ মুহূর্ত। এই মুহূর্তের দায় খুব তাড়াহুড়োয় বা রাতারাতি পূরণ সম্ভব নয়, তা–ও জানি। কিন্তু দিন শেষে এই দায় অপূরণীয় থাকলে আর যেই ছাড়ুক, ইতিহাস পিছু ছাড়বে না।
২
সমাজে শ্রমজীবীর আসল পরিচয় কী? তাঁর পাওয়া না–পাওয়া বা অধিকারই–বা কী? জাতীয় অর্থনীতির বিকাশের সঙ্গে শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়নের সংযোগ কী? সমাজের বাস্তব পাটাতনে এই হিসাব-নিকাশ বাদ দেওয়ার পথ নেই। নতুন করে এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া এখন আবশ্যক। কারণ, শ্রমিকের মৌলিক অধিকার কী অবস্থায় আছে, সেই আলাপ ছাড়া দেশে গণতন্ত্র, জবাবদিহি ও উন্নতির অগ্রগতির পরিমাপ সম্ভব নয়। ফ্যাসিবাদ সশরীর বিদায় হলেই শ্রমিক ও জনগণের জীবনমানে উন্নতি হয় না। মন ও মননে গেড়ে বসত করা ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতির সমূলে বদল হলে তবেই শ্রমিকের নাগরিক-গণতান্ত্রিক অধিকার ও ভয়মুক্ত কর্মপরিবেশ তৈরির পথ প্রশস্ত হয়। সুগম হয় জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ। তাই সমাজে বিরাজমান শ্রেণি-জাত-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গবৈষম্যের আলোকে এই চাওয়া-পাওয়ার সীমাকে পাঠ করতে হবে। বিশেষভাবে এ ক্ষেত্রে যুক্ত করা প্রাসঙ্গিক, নারী শ্রমিকের ওপর চাপানো ঘর-গেরস্তালি ও কর্মস্থলের দ্বৈত বোঝা এবং শ্রম খাত ও শ্রমিকের ওপর বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব প্রশ্নও।