
জমানো বৃষ্টির পানি শুষ্ক মৌসুমে বাঁচাতে পারবে উপকূলবাসীকে?
ফাল্গুন শেষে চৈত্র মাস শুরু হতেই চলছে সুপেয় পানির জন্য হাহাকার। এই হাহাকার দক্ষিণ উপকূলবাসীদের। প্রায় সব পানির উৎসগুলোতে লবণাক্ততা ব্যাপক আকারে বেড়ে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে উপকূলের নদীগুলোকে লবণাক্ত করে তোলে বঙ্গোপসাগরের নোনাপানি।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে গত ২৫-৩০ বছরে শুষ্ক মৌসুমে পানির উৎসগুলোতে লবণাক্ততা বাড়ার ফলে দেখা দিচ্ছে সুপেয় পানির তীব্র সংকট। যারা বর্ষার মৌসুমে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে রাখে, তারা কিছুটা স্বস্তিতে থাকে। আর যাদের সেই উপায় থাকে না, তাদের বাধ্য হয়েই খাওয়াসহ অন্যান্য কাজে লোনাপানিই ব্যবহার করতে হয়।
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে বিশেষভাবে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। জনশুমারি ও গৃহগণনা (২০২২) অনুযায়ী, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ১৯টি জেলায় বসবাস করেন প্রায় ৪ কোটি ৩৮ লাখ মানুষ।
উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, সংকট ও সম্ভাবনাময় এলাকা হিসেবে পরিচিত এই অঞ্চল জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডর এবং ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার পর প্রায় সব মিঠাপানির উৎসগুলোতে লোনাপানি ঢুকে নষ্ট হয়ে গেছে। কৃষিজমি ও মিঠাপানির উৎসগুলোতে লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে সৃষ্টি হচ্ছে সুপেয় পানির তীব্র সংকট এবং ব্যাহত হচ্ছে ফসলের স্বাভাবিক উৎপাদন।
বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন অনুযায়ী, দেশের উপকূলে গত চার দশকে লবণাক্ত জমির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ২৭ শতাংশ। ভূগর্ভস্থ পানির লবণাক্ততাও মাত্রাভেদে উপকূল থেকে ৫০ থেকে ৭০ কিলোমিটার উজান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। ফলে ভূগর্ভস্থ স্বাদুপানির উৎসগুলো তীব্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ দিন দিন বাড়ছে, ভূপৃষ্ঠের নিচে স্বাদুপানির মজুতও কমে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, উপকূলীয় এলাকায় লোনাপানি ও ভূগর্ভস্থ মিঠাপানি একটি ভারসাম্য বজায় রাখে। বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে জলাশয়ে স্বাদুপানি জমা হয়। তবে সমুদ্রের জোয়ার-ভাটার কারণে লোনাপানি ভূমির ভেতরে ঢুকতে চেষ্টা করে। ফলে একটি সাম্যাবস্থা সৃষ্টি হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে লোনাপানি লোকালয়ের মিঠাপানির অঞ্চলে প্রবেশ করায় প্রায় সব পানীয় জলের উৎস ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
দেশের দক্ষিণ উপকূলের বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, খুলনা জেলাতে রয়েছে সুপেয় ও নিরাপদ পানির তীব্র সংকট। উপকূলে যেসব এলাকায় পানি লবণাক্ত, সেখানে নিরাপদ পানির উৎসসমূহের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হচ্ছে মিঠাপানির পুকুর, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা, গভীর নলকূপ, পাইপলাইন সরবরাহ, পন্ড স্যান্ড ফিল্টার বা পিএসএফ, রিভার্স অসমোসিস বা আরও প্ল্যান্ট।
ভূগর্ভস্থ নিরাপদ পানি উত্তোলনের জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় গভীর নলকূপ। তবে উপকূলের বেশির ভাগ এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এসব নলকূপ দিয়ে পানি ওঠে না, আবার উঠলেও লোনাপানি ওঠে। এ ছাড়া শহর এলাকায় পাইপলাইনের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি তুলে অথবা ভূ-উপরিস্থ পানি তুলে শোধন করে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এই পানি সব সময় নিরাপদ হয় না।
গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠী খাওয়ার পানির জন্য মিঠাপানির পুকুর ব্যবহার করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মিঠাপানির পুকুরের দূরত্ব বেশি হওয়ায় মানুষকে মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে হয়। পন্ড স্যান্ড ফিল্টার বা পিএসএফের মাধ্যমে মিঠাপানির পুকুরে জমা বৃষ্টির পানি তুলে বালু ও নুড়িপাথরের ফিল্টার দিয়ে পরিশোধন করে পানের উপযোগী করা হয়। এই পদ্ধতি পরিবেশবান্ধব ও টেকসই। এ ছাড়া রিভার্স ওসমোসিস বা আর,ও প্ল্যান্টের মাধ্যমে লবণাক্ত পানি খাওয়ার পানিতে রূপান্তর করা যায়। তবে এই পদ্ধতি তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল ও রক্ষণাবেক্ষণ কঠিন।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বিশ্ব পানি দিবস
- সুপেয় পানি