
অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের ঝুঁকিতে শিশুরা, করণীয় কী?
অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার ছিল মানবসভ্যতার জন্য এক চরম আশীর্বাদ। ১৯২৮ সালে এক প্রকারের ছত্রাক থেকে আলেকজান্ডার ফ্লেমিং (Alexander Fleming) কর্তৃক পেনিসিলিন আবিষ্কারের পর ১৯৪০-এর শুরুর দিকে চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার শুরু হয়। বিশ্বে এখন পেনিসিলিনসহ প্রায় আড়াইশ অ্যান্টিবায়োটিক মানুষের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
অ্যান্টিবায়োটিকের ফলে ১৯৪০ থেকে অদ্যাবধি কোটি কোটি মানুষের জীবন রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু, সময়ের ব্যবধানে একই সময়ে বেড়েছে এ অপব্যবহার, অতিব্যবহার। এর ফলে এক সময়ের কাবু থাকা জীবাণুগুলো অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী বা রেজিস্ট্যান্ট হয়ে উঠেছে।
এখন এই অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স বা এএমআর (AMR) সারা বিশ্বের স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য এক মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিশু থেকে পূর্ণবয়স্ক সব মানুষ এখন অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের ঝুঁকিতে। অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স এমন একটি অবস্থা যখন কোনো ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ফাঙ্গাস এবং অন্যান্য জীবাণু অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিফাংগাল, অ্যান্টিভাইরাল বা অ্যান্টিপারাসাইট ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, ফলে সংক্রমণ নিরাময় করা কঠিন হয়ে পড়ে।
২০২২ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিখ্যাত জার্নাল ‘ল্যানসেট’-এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে ২০১৯ সালে শুধুমাত্র অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের কারণে সারা বিশ্বে প্রায় ১৩ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে যার মধ্যে ২০ শতাংশ (প্রায় আড়াই লাখ) ছিল পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু ও নবজাতক।
আর অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের কারণে অধিকাংশ শিশু মৃত্যু ঘটেছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয়। ২০১৬ সালের ল্যানসেটে প্রকাশিত আরেকটি গবেষণায় বলা হয়েছে, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের কারণে প্রতি বছর প্রায় দুই লাখ ১৪ হাজার শিশু ও নবজাতকের মৃত্যু ঘটে।
আতঙ্কের বিষয় হলো অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্ট (ওষুধ প্রতিরোধী) জীবাণুর সংক্রমণের কারণে সারা বিশ্বে বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় প্রতিবছর শিশু ও নবজাতক মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। ২০২৩ সালের মার্চ মাসে বিবিএস-এর সূত্র দিয়ে প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে এক সময়ে শিশু মৃত্যুর হার কমে গেলেও দিনে দিনে তা বেড়ে চলেছে।
২০১৭ সালে দেশে এক মাস, এক বছর এবং পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুহার ছিল হাজারে যথাক্রমে ১৫, ২১ এবং ২৮ জন, যা ২০২৩ সালে এসে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ২০, ২৭ ও ৩৩ জনে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মানসম্মত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, গর্ভকালীন ও প্রসবকালীন সেবা নিশ্চিত না হওয়া, জলবায়ু পরিবর্তন, ওষুধ প্রতিরোধী নানা জীবাণুর সংক্রমণ এ ঊর্ধ্বগতির অন্যতম কারণ। ওষুধ প্রতিরোধী জীবাণুর সংক্রমণ কমাতে না পারলে এ সংখ্যা দিনে দিনে আরও বাড়বে।
শিশু এবং নবজাতকরা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল প্রতিরোধের প্রভাবের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বড়দের মতো পরিপক্ক নয়। তাই বড়দের তুলনায় শিশুরা বিশেষত ৫ বছরের নিচের শিশুরা জীবাণুঘটিত রোগ সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকে। ২০২১ সালে জার্নাল অব গ্লোবাল হেলথে প্রকাশিত এক গবেষণা বলছে, বাংলাদেশ ৫ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর অন্যতম কারণ নিউমোনিয়া, যার কারণে প্রায় ১৯ শতাংশ শিশু মারা যায়। এরপর রয়েছে শ্বাসকষ্ট (১৬ শতাংশ), প্রিম্যাচিউর বার্থ (১১ শতাংশ), রক্তে জীবাণুর সংক্রমণ বা সেপসিস (৮ শতাংশ)। অর্থাৎ দেশে শিশু মৃত্যুর অন্ততপক্ষে ২৪ শতাংশ জীবাণুঘটিত সংক্রমণের কারণে হয়ে থাকে, যা একই সময়ে যুক্তরাজ্যের চেয়ে প্রায় ১০ শতাংশ বেশি।